হল রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন- কার লাভ, কার ক্ষতি

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবাসিক হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে গুপ্ত রাজনীতি বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এছাড়া প্রক্টর কি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রকারান্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধের কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি না’ এই প্রশ্নও উঠছে। এমনকি ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি এমন অংকও কষছেন কেউ কেউ।
অন্যদের বাধা দিলেও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে দেদারসে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা আব্দুল কাদের। গতকাল শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, শৃঙ্খলা কমিটি কিংবা ব্যাচ প্রতিনিধির নামে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা হলগুলোতে ছায়া প্রশাসন জারি রেখেছেন। আবাসিক হলগুলোয় গুপ্ত ও প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধের যে ঘোষণা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিয়েছে, তা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না।
তিনি লেখেন, এমন ঘোষণায় কেবল প্রকাশ্য রাজনীতিটা বাধাগ্রস্ত হবে, গুপ্তদের আটকাতে পারবে না। দুদিন পর আবারো পরিস্থিতি বেগতিক হবে। তাছাড়া এর আগেও এমন ঘোষণা বহুবার হয়েছে; সমাধান হয়নি। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থী, ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একত্রে বসে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমন্বিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সুস্পষ্ট রূপরেখা হাজির করা। সব পক্ষ একটা চুক্তিতে আসা ব্যতিত এ অবস্থার কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নেই।
ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জুলাই আন্দোলনের সময়কার নয় দফার মধ্যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ঢুকাতে চেয়েছিলেন বলেও মন্তব্য করেন আব্দুল কাদের। তিনি লিখেছেন, ফরহাদ সাহেব সপ্তম দফায় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ঢুকাতে চেয়েছিলেন। এটা নিয়ে তার সঙ্গে আধা ঘণ্টার বেশি সময় তর্ক-বিতর্ক হয়। আমি তখনো তাকে স্পষ্ট করে বলেছি, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা আসল সমাধান নয়। আর রাজনীতি বন্ধ করলে কার লাভ, সেটাও তাকে ধরিয়ে দিয়েছি।
আব্দুল কাদের বলেন, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি কিংবা রাজনীতি বন্ধ করাও যেহেতু ফিজিবল না, সেজন্য ৫ আগস্টের পরে ভিন্ন কাঠামো ভাবার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। যদিও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা গোষ্ঠী তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, মব ক্রিয়েট করেছেন, কিন্ত শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও এই মবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যদি উদাহরণ দিতে বলেন, তাহলে বলি ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সম্মুখ সারিতে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি পরবর্তী সময়ে শিবিরের ঢাবি শাখার প্রকাশিত কমিটির ছাত্র আন্দোলন-বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন! ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের আহ্বান জানানো, আন্দোলন করা মুনতাসীর পরবর্তী সময়ে তিতুমীর কলেজ শাখা শিবিরের সেক্রেটারি হিসেবে আবিভর্‚ত হলেন! শিবিরের প্রতিটা ইউনিট ক্যাম্পাস ও হল কমিটি প্রকাশ করলে এমন অসংখ্য চমক হয়ত আমরা দেখতে পেতাম।
কাদেরের অভিযোগ, হলের শৃঙ্খলা কমিটির অধিকাংশই ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত। তারা অনলাইন ভোটাভুটিতে কারচুপি করে এসব প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলছেন, এগুলো তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়ার একটা রাজনীতি।
যেভাবে এলো প্রক্টরের নিষিদ্ধের ঘোষণা
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের জন্য সংগঠনটির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। এরপর ওই দিন মধ্যরাতে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। একপর্যায়ে রোকেয়া ও শামসুন নাহার হল থেকে ছাত্রীরা বের হয়ে গেলে অন্য হলগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়। বিভিন্ন হল থেকে কয়েকশ ছাত্রছাত্রী বাইরে বেরিয়ে আসেন। রাত একটার দিকে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন তারা।
শুক্রবার রাত দুইটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাদের সঙ্গে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা হয়। তখন উপাচার্য বলেন, হল পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হল প্রভোস্টের নেয়া সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
তিনি বলেন, হল পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে। উপাচার্যের এ বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা ‘না, না’ বলে আপত্তি জানান এবং হলগুলোতে সম্পূর্ণভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেন। পরে রাত তিনটার দিকে বিক্ষোভের মুখে প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ হলগুলোতে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন।
শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের আশ্বাসে উল্লাস প্রকাশ করে হলে ফিরে যান। প্রক্টরের ওই ঘোষণার আধঘণ্টা পর স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট অফিস থেকে এক প্রজ্ঞাপন আসে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কমিটিভুক্তরা পদত্যাগ ও মুচলেকা প্রদানসাপেক্ষে হলে অবস্থান করতে পারবেন। অন্যথায় তাদের হল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
এর আগে শুক্রবার ছাত্রদলের হল কমিটি প্রকাশের পর হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়ে নিজ হল সুফিয়া কামালের প্রাধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক নেত্রী উমামা ফাতেমা। তিনি মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছিলেন। উমামা গতকাল রাতে এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, হলে রাজনৈতিক সংগঠনের কমিটি করার সুযোগ দিলে সেখানে পেছনের দরজা দিয়ে দখলদারি প্রবেশ করবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থী সবার মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত আসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে গুপ্ত রাজনীতি বেড়ে যাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যেসব ছাত্র সংগঠন সক্রিয় আছে তাদের দিক থেকে এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। কয়েকটি সংগঠন পরস্পরের বিরুদ্ধে নিজস্ব দলীয় স্বার্থে আন্দোলন উসকে দেয়ার অভিযোগ করেছে। হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টিকে বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা বলছেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন। তিনি বলেন, প্রক্টর কি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন? তিনি হয়তো উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে এমনটি বলেছেন। হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে গুপ্ত রাজনীতি বেড়ে যাবে বলে মনে করেন।
বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতারা মনে করেন, হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দেয়ার এখতিয়ার প্রক্টরের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো পরিসরে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমোল্লার বসু বলেন, ক্যাম্পাসে যারা প্রকাশ্য রাজনীতি করে; তাদের নেতিবাচকভাবে আর যারা গুপ্ত রাজনীতি করে তাদের ইতিবাচকভাবে দেখানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বা ফ্যাকাল্টিতে রাজনীতি না করে আমরা কি সচিবালয়ে গিয়ে রাজনীতি করব?
আবাসিক হলে ছাত্র রাজনীতি দরকার নেই বলে মনে করে ইসলামী ছাত্রশিবির। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, শিবির দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, হলে রাজনীতি না হোক। আমরা চাই, হলের বাইরে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় রাজনীতি করুক।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দিন পর ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ। ওই সময় শিক্ষার্থীরা প্রতিটি হলের হল প্রাধ্যক্ষদের কাছ থেকে আবাসিক হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে, এমন বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর নেয়। মূলত সেই বিজ্ঞপ্তির আলোকে শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করায় ক্ষোভ জানায়।