জাতীয় নির্বাচন: ইসির সামনে হরেক চ্যালেঞ্জ

হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:০৯ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বারবার জোর দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে- অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া হবে। এই নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। পাশাপাশি ‘নির্বাচন ভণ্ডুলের ষড়যন্ত্রের কথাও’ বলা হচ্ছে। তাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনেকের মনেই রয়েছে সন্দেহ-শঙ্কা। যদিও ইতোমধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। সে আলোকে ভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
এখন জাতীয় (জুলাই) সনদের আইনিভিত্তি, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন, গণভোট, জোট গঠন, জাতীয় পার্টি ও ক্রার্যক্রম নিষিদ্ধ অনুপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগের বিষয়টি চূড়ান্ত করাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে বিভেদ ক্রমশ বাড়ছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। এই অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অনেকের অভিমত, এ মুহূর্তে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকার ও ইসির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- প্রশ্নমুক্ত, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- বিভেদ দূর করে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ভোটারের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ও আস্থা নিশ্চিত করা। এছাড়া নাগরিক ও রাজনৈতিক দল সবার জন্য আস্থার পরিবেশ তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা ও ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির বড় অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে- নতুন ৬০ লাখ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও ২০ লাখ মৃত ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া, ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুননির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, উপযুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দল ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন।
ইসি মনে করছে, অতীতের যে কোনো নির্বাচন থেকে আসন্ন নির্বাচন অধিক চ্যালেঞ্জের। তবে শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) কমিশন দুটি চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছে। একটি হলো- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপপ্রয়োগ এবং আরেকটি প্রবাসীদের ভোটাধিকার।
ইসি সূত্র বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে গতি আনছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রুটিন কার্যক্রম আগেই শুরু হয়েছিল। এখন কাজ আরো গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শেষ করতে হয়। এ ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
জুলাই আন্দোলনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার দাবি উঠেছে। এজন্য নির্বাচন সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রম করেও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব হয়নি। এখন কতটা শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় দূর হচ্ছে না।
শনিবার রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় মিলনায়তনে ‘নির্বাচন কর্মকর্তা সম্মেলন-২০২৫’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনে আমরা আপনাদের নির্দেশনা দেবো, কিন্তু বেআইনি কোনো নির্দেশনা আমরা দেব না। কাউকে ফেভার করার জন্য নির্দেশনা দেব না। আমাদের নির্দেশনা হবে সম্পূর্ণ আইন ও বিধি মোতাবেক। আমরা নিশ্চিত করতে চাইÑ আপনারা কাজটা সঠিকভাবে করছেন, এটা যারা ইলেকশনের সঙ্গে জড়িত থাকবেন তাদের সবার জন্য প্রযোজ্য।
সিইসি বলেন, এবারের নির্বাচন বিশেষ পরিস্থিতিতে হচ্ছে। তাই আমাদের বিশেষভাবে এটা মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষভাবে এটাকে ফেস করতে হবে। যারা বিদেশে আছেন তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবো। যারা জেলখানায় আছেন, যারা সরকারি কর্মকর্তা তাদের ভোটে আনার কথা ভাবছি। এই কাজগুলো নতুন। আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ নিয়ে ফেললাম।
এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে কাজ করা খুবই ডিফিকাল্ট। পার্টিকুলারলি যেই অবস্থার মধ্য দিয়ে দেশটা যাচ্ছে, তাতে কাজ আদায় করে নেয়া কঠিন। কিছু কিছু পক্ষের লোকের জন্য খুব সুবিধা। আর বেশির ভাগ পক্ষের লোকের জন্য ডিফিকাল্ট। এই সিচুয়েশনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে যতগুলো বক্তৃতা দিয়েছেন- সেখানে বলেছেন, বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং ঐতিহাসিক নির্বাচন হবে। সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রধান উপদেষ্টার পূর্ণ আস্থা আছে বলেই কিন্তু তিনি প্রতিনিয়ত বলে আসছেন- আমি বাংলাদেশে একটা ঐতিহাসিক নির্বাচন দেব। তাই আমাদের তার এই আস্থা ও বিশ্বাসটা ধরে রাখতে হবে। আমাদের প্রমাণ করতে হবে, আমরা এটা পারি। আমি নিশ্চিত আপনাদের সহযোগিতা নিয়ে আমরা একটা ভালো নির্বাচন করতে পারব।
নির্বাচন কর্মকর্তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমি গত ২ মার্চ, ১ রমজানে আপনাদের শপথ করিয়েছিলাম। আপনারা কিন্তু ওয়াদা করেছিলেন- নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন। প্রফেশনালি কাজ করবেন। আইন মেনে কাজ করবেন।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমরা সময়ের ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে আছি। তার এক নম্বর কারণ নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। যে সব কারণে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে তার প্রধান কারণ দেশে ভালো নির্বাচন না থাকা। চোখ বন্ধ করে দেখেন, জুলাই আন্দোলন কেন হলো, তার প্রধান কারণ পচা নির্বাচন বা নির্বাচনের নামে প্রহসন।
মাঠ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ইসি সানাউল্লাহ বলেন, আমরা আর কখনো পচা নির্বাচন করব না। পক্ষপাতমূলক দুষ্ট নির্বাচনের জন্য ইসি আপনাদের চাপ দেবে না, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলবে না। নির্বাচনে যদি কেউ অনিয়ম করে তাহলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে, ইসি কোনো দায়িত্ব নেবে না।
জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, সুষ্ঠু, সুন্দর, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা ইসির ওপর আমানত। ইহকাল, পরকালে জবাবদিহিতা আছে। ভালো নির্বাচন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। কারণ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, অতীতের যে কোনো নির্বাচন থেকে আসন্ন নির্বাচন চ্যালেঞ্জের। আমরা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে চাই। তিনি বলেন, ইসির চ্যালেঞ্জ দুটি। একটি হলো এআইর অপপ্রয়োগ, আরেকটি প্রবাসীদের ভোটাধিকার। আমরা প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করব। এআইর অপব্যবহার এবং পোস্টাল ভোটিংয়ের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সুন্দর নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে।
ইসির সিনিয়র সচিব বলেন, ধাপে ধাপে কাজ করছি, ওভারনাইট কিছু হবে না। আমরা কাজ করে সব কিছু আদায় করতে চাই। ভালো নির্বাচনের বিকল্প নেই, এটির জন্য জাতি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কোনো কৃপণতা নেই। আমরা চেষ্টা করছি সব কাজ ভালোভাবে করতে।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন- নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিনা আহমেদ ও আনোয়ারুল ইসলাম সরকার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মনির হোসেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নিয়োগের দাবি জানান।