জুলাই সনদ-গণভোট
ঐকমত্যের চ্যালেঞ্জে সরকার
হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:০৪ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচনের ডেটলাইন মধ্য ফেব্রুয়ারি- দিন যত ঘনিয়ে আসছে জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরিতা তত বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সাত দিনের সময় সীমা বেঁধে দেয়ার মেয়াদ শেষ হলেও তিক্ততা চরমে পৌঁছেছে। অসহিষ্ণু রাজনীতিতে দেশও এখন অস্থিরতায়। আগে নির্বাচনের দিন গণভোটের দাবি করে এলেও বিএনপি ও তার অনুসারীরা এখন বিদ্যমান সংবিধানের ওপর ভর করেছে। একইসঙ্গে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের বাইরের কোনো ইস্যু মানবে না বলে জানিয়েছে দলটি। এমনকি সরকারপ্রধানের দ্বৈত ভূমিকায় ‘স্বার্থের সংঘাত’ হচ্ছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে বিএনপির তরফে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের অনুসারী দলগুলো আদেশ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনীভিত্তি এবং এর ওপর নির্বাচনের আগে চলতি নভেম্বরেই গণভোটের পক্ষে আরো কঠোর হয়েছে। রবিবারের মধ্যে এই দাবি মানার হুঁশিয়ারি দিয়েছে দলটি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আনা এখন ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। অবশ্য দেশে রাজনৈতিক সংকট দূর করতে সরকারকেই রেফারির ভ‚মিকা পালন করতে হয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও সরকারই রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ ইতোমধ্যে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে সরকারের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দুই-তিন দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে সরকারের তরফে বলা হয়েছে। আজ দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি দেশের মানুষ মুখিয়ে আছেন সরকারের পদক্ষেপ ও ঘোষণা জানার অপেক্ষায়।
৩০টি রাজনৈতিক দলের মতমতের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ১৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও ২৫টি রাজনৈতিক দল এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া এবং জুলাই সনদ প্রণয়নের দাবি তোলা তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি সনদে সই করেনি আইনি ভিত্তি না দেয়ায়। এছাড়া জুলাই সনদে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি বাদ দেয়ায় এতে সই করেনি সিপিবিসহ চারটি বাম দল। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা না থাকায় বিতর্ক ও চরম মতবিরোধ দেখা দেয় রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে। এই প্রেক্ষাপটে ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায়ের সুপারিশ তৈরি করে ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে। সুপারিশে বলা হয়, জুলাই সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে।
গণভোটে প্রস্তাবগুলো পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। আর এই সময়ের মধ্যে পরিষদ সেটি করতে না পারলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। এর তীব্র সমালোচনা করছে বিএনপি। তবে গণভোট নির্বচানের দিন কিংবা আগে হতে পারে বলে সুপারিশ করে এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি এতে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) বাদ দেয়া হয়। এই সুপারিশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো। জুলাই সনদ নিয়ে জাতির সঙ্গে সরকার প্রতারণা করছে বলেও মন্তব্য করেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও তার অনুসারীরা সুপারিশ নিয়ে ইতিবাচক হলেও আগে গণভোট চায়। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তা করছে সরকার।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য সরকার ও কমিশনকেই প্রকাশ্যে দোষারোপ করে আসছে বিএনপি ও জামায়াত। এতে শুধু বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্বই নয়, সরকারের সঙ্গে বোঝাপাড়ায় মতানৈক্য ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানায় ঐকবদ্ধ নির্দেশনা চেয়ে। তবে দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানানো হয়েছিল। গত ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভা থেকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এই সময়সীমা রবিবার শেষ হয়েছে। সরকারের এমন অবস্থানে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি ও তার অনুসারীদের মঝে বিতর্কের সৃষ্টি করে। দলগুলো আলোচনায় বসা তো দূরের কথা উল্টো বাগাড়ম্বর চলছে।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আজ বৃহস্পতিবার একটি মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। এই রায় ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আজকের লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করায় রাজনীতিতে প্রভাব পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আনা এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সরকারের পক্ষে পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রæয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে। গতকালও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এখন আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, যা জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি মঙ্গলবার জানিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে উল্লিখিত বিষয়াদির বাইরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দলের জন্য তা মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সেই ক্ষেত্রে সব দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তাবে। দলটি আরো জানায়, সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে কোনো কোনো বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রসঙ্গে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বিভ্রান্তিকর এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করার শামিল।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন, দেশের বিদ্যমান সংবিধানে গণভোটের বিষয়ে উল্লেখ নেই। নির্বাচিত সরকার যদি সংবিধানে গণভোট অন্তর্ভুক্ত করে তারপরে, তা হতে পারে। অবশ্য এর আগে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে আলাদা ব্যালটে গণভোটের দাবি জানিয়ে আসছিল প্রভাবশালী এই দলটি।
সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বৈত ভূমিকায় ‘স্বার্থের সংঘাত’ হচ্ছে। এখানে ক্ল্যাশ অব ইন্টারেস্ট আছে। এ সরকার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে সহযোগিতায় থাকব, ভোটে অংশগ্রহণ করব, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করব। কিন্তু সেই সরকারের প্রধান হিসেবে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে যে সুপারিশগুলো সরকারের কাছে দেয়া হলো, সেখানে অনেকটা জুলাই জাতীয় সনদ যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার থেকে বহুদূরে সরে গিয়েছেন।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং আদেশের ওপর নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে আগামীকাল শুক্রবার দেশব্যাপী জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল করবে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল। রবিবার দুপুরে আট দলের বৈঠক। এই বৈঠকের আগে দাবি মানা না হলেও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, যমুনার সামনে, অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি করা হয়। একই দাবিতে সেপ্টেম্বর মাস থেকে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছে দলগুলো। মঙ্গলবার ঢাকায় আট দলের সমাবেশে বলা হয়, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণভোট ছাড়া নির্বাচন হবে না। যারা জুলাাই আন্দোলন মানবে না তাদের জন্য ২০২৬ সালে নির্বাচন নেই। সরকার যদি জনগণের ও আট দলের নেতাদের শান্তিপ্রিয় ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হয়, যেই ভাষায় বললে সরকার বুঝবে, আমরা সেই ভাষা প্রয়োগ করব। সেই কর্মসূচিই ঘোষণা করব।
তবে সরকার ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতসহ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদেও আলোচনা হয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতামত তুলে ধরেছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ যেসব মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়গুলো গণভোটে রাখা হবে। সরকার আশা করছে, দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মঙ্গলবার বলেছেন, আমরাদের প্রত্যাশা ছিল- রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের একটা ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেবেন। তবে প্রত্যাশা করেই আমরা বসে থাকিনি। আমরা উপদেষ্টা পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ে এটা আলোচনা করছি। সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যেই পরিষ্কারভাবে সিদ্ধান্ত জানাবে। সব দলের প্রত্যাশার প্রতি সমন্বয় ঘটিয়ে দেশের এবং জনগণের স্বার্থে যা করা দরকার সেটাই আমরা করতে যাচ্ছি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে বলেও আশা করেন তিনি।
