সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি ভাঙা নিয়ে বিতর্ক: আসল ইতিহাস কী?

সাইফুল ইসলাম শান্ত
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম

সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি
সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে “নরসিংদীর শিবপুরে সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি ভেঙে দিচ্ছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।” খবরটি দেশ-বিদেশে সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ সত্যজিৎ রায় শুধুমাত্র ভারতের নয় তিনি উপমহাদেশের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সঙ্গীত পরিচালক এবং বাংলা সংস্কৃতির গর্ব। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি শিশু-কিশোর সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন; ফেলুদা তার সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র। তিনি কলকাতার শিল্পপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন—তার পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বাবা সুকুমার রায় ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। তার নামের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো স্থাপনা ধ্বংস হওয়ার খবর স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণকে স্পর্শ করবে। কিন্তু এই খবরের কোনো বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রকৃত পক্ষে, শিবপুরে যে ভবনটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে সেটি ১৯৮৭ সালে সরকারিভাবে ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’র নামে লিজ দেয়া হয়েছিল। ভবনটি ছিল পুরনো ও কাঠামোগতভাবে বিপজ্জনক, যা ২০০৭ সালেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে লিজ হস্তান্তর সম্পন্ন হওয়ার পর সম্প্রতি স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে নতুন স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী ভাঙার কাজ শুরু হয়।
এই ভুল ধারণার পেছনে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কাজ করেছে। শিবপুরে একটি রাস্তার নাম ছিল “হরিকিশোর রায় রোড”, যা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের পারিবারিক নামের সঙ্গে মিলে যায়। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত একটি পুরনো বাড়ি “পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন”-যা সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অনেকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু ভবনটি মূলত হরিকিশোর রায়ের দত্তক পুত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়ের স্ত্রী পূর্ন্যলক্ষ্মীর নামে “পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন” নামে পরিচিত হয়। উক্ত বাড়িটি ১৯১৫-১৯২৫ সাল সময়ে নির্মিত হয়। বাড়িতে আনুমানিক ১৯৪৮ পর্যন্ত সময়ে সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ পরিবারসহ হরিকিশোর রায়ের দত্তক পুত্র হিসেবে বসবাস করেন। উপেন্দ্রকিশোর রায় পরিবারসহ কোলকাতায় চলে গেলে, তার (দত্তক সূত্রে) ভাই নরেন্দ্রকিশোর রায় ‘পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন’ নামের বাড়িটি ১৯৪৮ সালে বিক্রয় করেন। সূত্রানুসারে, ‘পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন' ১৯৫৩ সালে ভেঙে ‘দুর্লভ ভবন' এবং পরবর্তীতে ২০১২ সালে ‘দুর্লভ ভবন’ ভেঙে ‘দুর্লভ ডালিয়া টাওয়ার' নামে নতুন ১৪তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। তবে এই “পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন”আর বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ভবন এক নয়। শিবপুরে যে কোনো পুরনো ভবন ভাঙার ঘটনাকে ভুলভাবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যুক্ত করা যুক্তিসংগত নয়।
ময়মনসিংহের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক স্বপন ধর সূত্রে জানা যায়, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি নয়। এই ভবনটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজসেবক, জমিদার ও দানবীর ব্যক্তিত্ব ‘রণদা প্রসাদ সাহা' (যিনি আর.পি সাহা নামে অধিক পরিচিত) এর একটি অস্থায়ী বাসভবন ছিল। ভবনটি মূলত উনিশ শতকের শেষভাগ বা বিশ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত হয়। এটি পূর্বে স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র (Old DC Power Station বা “বিদ্যুৎ কল”) হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা ১৯২০-এর দশকে শুরু হয়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রণোপ্রসাদ সাহার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণোপ্রসাদ সাহার মৃত্যু হয় এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট ভবন সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৮৭ সালে সরকার এটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির জন্য লিজ প্রদান করে। লিজ নেয়ার পর ভবনটি শিশু একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যবহার করা হলেও দীর্ঘ সময় ব্যবহৃত হওয়ার ফলে কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুপযোগী হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
২০০৯-২০১০ সালে সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে শিবপুর অঞ্চলের ৩২০টি ঐতিহাসিক স্থাপনা শনাক্ত করা হয়, যার মধ্যে ৫৪টি দ্বিতীয় শ্রেণির সংরক্ষণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এর মধ্যে শিশু একাডেমির এই ভবনটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, এই শ্রেণির ভবন ধ্বংস না করে সংস্কার বা পুনঃব্যবহারযোগ্য করার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ভবনটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ও বিপজ্জনক হওয়ায় ২০০৭ সালেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং পুনর্নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির নামে পুনরায় লিজ চুক্তি নবায়ন করা হয়। এরপর ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর নরসিংদী পৌরসভার এক সভায় পুরনো ভবন অপসারণ করে একই জায়গায় নতুন শিশু একাডেমি ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এদিকে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মাসুয়া গ্রামে সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর এর পৈত্তিক তথা পূর্বপুরুষদের একটি স্থায়ী নিবাস (জমিদার বাড়ি) রয়েছে। উক্ত বাড়িটি ১৮০০ সালের দিকে সত্যজিৎ রায়ের ৩য় পূর্বপুরুষ রমাকান্ত দেব কর্তৃক স্থাপিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর রায় ১৮৬০ সালে উক্ত জমিদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সত্যজিৎ রায় এর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় ও তার ভাই-বোনেরা সকলে স্থায়ীভাবে কোলকাতা যাওয়ার পর আনুমানিক ১৯৪৮ সালের পর উক্ত পরিবারের নিকট আত্মীয়দের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়নি। এছাড়া, রায় পরিবারের কোন সদস্য সর্বশেষ কখন উক্ত বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন, এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সত্যজিৎ রায় এর পূর্বপুরুষদের উক্ত বাড়িটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এসব তথ্যে দেখা যায় যে বাড়িটি ঘিরে তথ্য বিভ্রান্তি দেখা গেছে সেটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের বাড়ি না। তথ্য যাচাই ছাড়া সংবাদ প্রচারের কারণে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে যথাযথ নথিভুক্তি না থাকার কারণে অনেক পুরনো স্থাপনা নিয়ে গুজব বা ভুল ধারণা সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক স্থাপনা সম্পর্কিত যেকোনো সিদ্ধান্তের আগে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সাথে আমাদের যোগাযোগ করা প্রয়োজন।
এই পুরো বিতর্ক দেখিয়ে দিয়েছে যে, ঐতিহাসিক তথ্য যাচাই ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা গণমাধ্যমে খবর ছড়ানো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। একটি ভুল শিরোনাম জাতীয় ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন শিল্পীর (সত্যজিৎ রায়) নামের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক তৈরি করেছে। ভাঙা ভবনটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের কোনও সম্পর্ক নেই।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষায় আমাদের মনোভাব কতটা সচেতন? যে ভবনটিকে দ্বিতীয় শ্রেণির সংরক্ষণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেটি কেন এতদিন অবহেলায় নষ্ট হতে দেয়া হলো? পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও তা ভাঙার আগে বিকল্প পরিকল্পনা বা সংরক্ষণের চেষ্টা কেন নেয়া হলো না? এ ধরনের স্থাপনা পুনর্গঠন ও সংরক্ষণের জন্য সুস্পষ্ট নীতি এবং বাস্তবায়ন জরুরি।
সত্যজিৎ রায়ের নাম শুধু একটি ব্যক্তি বা চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম নয় বরং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তার নামের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো বিষয় জনমনে আবেগের সৃষ্টি করবে—এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো অগ্রহণযোগ্য। ভাঙা ভবনটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পারিবারিক ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ঐতিহাসিক সত্য যাচাই, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষা এবং তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা এখন সময়ের দাবি।