মিলিও স্টেশন: সুইডেনের আবর্জনা নয়, সচেতনতার মডেল
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৪১ এএম

সুইডেনের মিলিও স্টেশন
সুইডেন পরিচ্ছন্ন, শান্তিপূর্ণ এবং পরিবেশবান্ধব জীবনধারার এক আদর্শ রাষ্ট্র। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে এক গভীর কাঠামোগত শৃঙ্খলা ও নাগরিক সচেতনতা, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—“মিলিও স্টেশন”। বাংলায় একে বলাই যায়, পরিবেশ সংরক্ষণের আধুনিক কর্মশালা।
এই কেন্দ্রগুলোতে কেবল আবর্জনা ফেলা হয় না, বরং এখানে একটিকে অন্য কিছুতে রূপান্তরের নিরব প্রক্রিয়া চলে—গাড়ির পুরনো টায়ার থেকে শুরু করে রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসর, কিংবা এক্সিডেন্টে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির আসবাব পর্যন্ত। সবকিছুকেই যত্ন নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়—কী ফেলা হবে, আর কী আবারও কাজে লাগানো যাবে।
কীভাবে কাজ করে মিলিও স্টেশন?
সুইডেনের প্রতিটি কমিউনে থাকে এই মিলিও স্টেশন, যেখানে গৃহস্থালি এবং শিল্পবর্জ্য আলাদা আলাদাভাবে নেওয়া হয়। প্রধান বিভাগগুলো সাধারণত এইরকম:
• ইলেকট্রনিক বর্জ্য (TV, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, চার্জার)
• গাড়ির যন্ত্রাংশ (টায়ার, ব্যাটারি, হেডলাইট, দরজা)
• বাগানের বর্জ্য (পাতা, ডাল, ঘাস)
• বিষাক্ত বর্জ্য (ব্যাটারি, পুরনো রং, রাসায়নিক)
• কাঠ, প্লাস্টিক, ধাতব বস্তু, কাচ
নাগরিকেরা নিজের গাড়ি বা ট্রলিতে এসব নিয়ে এসে নির্ধারিত কন্টেইনারে ফেলে দেন। কোথায় কী ফেলতে হবে, তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা থাকে। প্রয়োজন হলে কর্মীরা সহযোগিতা করেন।
এক্সিডেন্টে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির ভেতরে সম্ভাবনার খনি
গাড়ি দুর্ঘটনার কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেলেও অনেক অংশ ঠিকঠাক থাকে—যেমন:
• টায়ার
• হেডলাইট
• রেডিও
• সিট
• দরজা
• এক্সেল বা ব্রেক ইউনিট
এই যন্ত্রাংশগুলো সরাসরি ফেলা হয় না। বরং সরকার অনুমোদিত Bilskrot বা Bildemontering företag-এ সেগুলো যাচাই-বাছাই, পরিষ্কার এবং পরীক্ষার মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের উপযোগী করা হয়।
ব্যক্তিরা চাইলে:
• অনলাইন মার্কেটপ্লেস (যেমন: Bildelsbasen.se, Blocket.se)
• স্থানীয় স্ক্রুট কোম্পানি
এর মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে সেই পার্টস কিনে নিতে পারেন।
অন্যান্য যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রেও একই চর্চা
একটি পুরনো রেফ্রিজারেটর হয়তো আর ঠাণ্ডা করে না, কিন্তু তার কম্প্রেসর, ফ্যান মোটর, বা থার্মোস্ট্যাট এখনো ভালো অবস্থায় রয়েছে। কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ, টিভির ডিসপ্লে প্যানেল—সবই পুনঃব্যবহারের যোগ্য। এগুলো অনেক সময় নেয়া হয় সুইডেনের অনন্য উদ্ভাবন ReTuna återbruksgalleria-তে, যেখানে পুরনো যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয় নতুন পণ্য, যা আবার বিক্রি হয় অত্যন্ত সাশ্রয়ী দামে।
পরিবেশ ও অর্থনীতির অভাবনীয় সমন্বয়
এই পদ্ধতির মাধ্যমে সুইডেনে বছরে:
• ৯০% এর বেশি বর্জ্য পুনঃব্যবহার হয়
• ল্যান্ডফিল (আবর্জনার স্তূপ) প্রায় শূন্য
• নতুন যন্ত্রাংশের জন্য খরচ ৪০-৭০% পর্যন্ত সাশ্রয়ী
• কর্মসংস্থান তৈরি হয় রিসাইক্লিং ও কারিগরি খাতে
এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়, বরং জীবনের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি সম্মান প্রকাশ।
নাগরিক শিক্ষায়ও এর অনুরণন
স্কুল থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে মানুষ শেখে কীভাবে বর্জ্য আলাদা করতে হয়, কোনটা ফেলা যাবে, আর কোনটা আবারও ব্যবহারযোগ্য। সন্তানরা বাবার সঙ্গে মিলিও স্টেশনে গিয়ে শিখছে দায়িত্ব ও সচেতনতা। এটি আসলে এক ধরনের নৈতিক শিক্ষা—যা সুইডেনের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় ছোটবেলা থেকেই।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিক্ষা
বাংলাদেশে এখনো:
• গাড়ি বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা হয়
• চোরাই যন্ত্রাংশের বাজারে রিস্ক বেশি
• পরিবেশদূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে
এখানে সুইডেনের এই মডেল অনুকরণ করে তৈরি করা যেতে পারে:
• সিটি করপোরেশন-ভিত্তিক আধুনিক মিলিও স্টেশন
• সরকার অনুমোদিত স্ক্রুট কোম্পানি
• অনলাইন পার্টস রিসেল প্ল্যাটফর্ম
• পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা
শেষ কথা : বাতিল নয়, পুনর্জন্ম
একটি পুরনো গাড়ি কিংবা অকেজো টিভি আসলে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার একটি দরজা। সুইডেনে প্রতিটি মিলিও স্টেশন একটি টেকসই সমাজের নীরব চালিকা শক্তি, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে পরিবেশ রক্ষার অংশ মনে করে।
এটি শুধুই একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়—বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাংলাদেশসহ যেসব দেশ এখনো পরিবেশ ও পরিকল্পনার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে, তাদের জন্য এটি হতে পারে আলোকবর্তিকা।
রহমান মৃধা, সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, [email protected]