নির্বাচন ঘিরে সংকট: ক্ষমতার লড়াই রাজপথে
সামনে পিআর-সনদ, পেছনে ভোট

হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ট্রেন চলছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনও তৎপর। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতায় অস্পষ্টতা ফুঠে উঠেছে। উত্তাপ বাড়ছে রাজপথে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনার পরও জাতীয় (জুলাই) সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তারও সুরাহা হয়নি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়েক মাস ধরে যে বিরোধ চলছে, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
জুলাই সনদের সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে বিএনপি ও কিছু বামপন্থি দল। পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচনেরও ঘোরবিরোধী তারা। এছাড়া জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধসহ আরো বেশ কিছু ইস্যুতেও বিপরীত মেরুতে তাদের অবস্থান। অন্যদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের কার্যকক্রম নিষিদ্ধসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে একাট্টা জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি দল। দলগুলো এই ইস্যুতে রাজপথে নামছে যুগপৎ আন্দোলনে। এছাড়া পিআর বাদে বাকি চার দাবিতে এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ পৃথক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগবিরোধী এসব ধর্মভিত্তিক ও ডানপন্থার দলগুলো এখন দ্বিধাবিভক্ত। সৃষ্টি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দলগুলোর সমঝোতা জটিল হয়ে উঠছে। ফলে আলোচনার টেবিল থেকে রাজপথে গড়াচ্ছে রাজনীতি, যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতে বাড়ছে উদ্বেগ ও শঙ্কা। এখন বিএনপি যদি রাজপথে পাল্টা আন্দোলনের ডাক দেয় তাহলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে জুলাই সনদ অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করলেও তার স্বীকৃতি দিতে হবে জাতীয় সংসদকে। সে সংসদে তো বিএনপি, জামায়াতসহ সব দল থাকবে। সে ক্ষেত্রে জুলাই সনদের বিষয়ে আলোচনার টেবিলে সমাধানের তাগিদ দেন তারা।
প্রসঙ্গত, ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় আরো এক মাস বাড়িয়ে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ফলে আলোচনার পথ এখনো খোলা রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে ৭ সদস্যের ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করেন। তিনি এই কমিশনের সভাপতি হন এবং আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়। এই কমিশন গত মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করে আসছে। প্রথম ধাপে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা করে বসেছিল কমিশন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি দল ও জোট নিয়ে ২৩ দিন সংলাপ হয়।
দুই ধাপের সংলাপে ১৬৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৮৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়, যার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে কমিশন। কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না হওয়ায় ঝুলে আছে সনদে স্বাক্ষর। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে সরকার ও কমিশনের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। সর্বশেষ গত রবিবার কমিশনের তৃতীয় ধাপের সংলাপের দ্বিতীয় দিনে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহমম্মদ ইউনূস। এ বৈঠকেও কোনো সমাধানে আসতে পারেনি দলগুলো ও সরকার। ওই দিনের সভায় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জুলাই সনদ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসতেই হবে।
কিন্তু এর এক দিন পরই সোমবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সংবাদ সম্মেলন করে ৫ দফা দাবিতে ৩ দিনের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। দাবিগুলো হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রæয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা, জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা, সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
জামায়াত ঘোষিত কর্মসূচিগুলো হলো ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব জেলা বা উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল। অভিন্ন দাবি নিয়ে ওই দিনই সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের একই ধরণের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলনে যাচ্ছে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ইত্যাদি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে নয়, তারা উচ্চকক্ষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও গণভোট চায়। যে কারণে তারা যুগপৎ আন্দোলনে না গিয়ে বাকি চারটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবিতে রাজপথে পৃথক কর্মসূচি দেবে। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, আমরা আমাদের মতো কর্মসূচি দেব। জামায়াত বা ইসলামী আন্দোলন যেসব দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে, পিআর পদ্ধতি ছাড়া সব বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত আছি। তবে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছি না। কিন্তু বাকি চারটি দাবি আদায়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার ভিত্তিতে আমরা কর্মসূচি দেব।
সরকার ও নির্বাচন কমিশন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছে; যার রোডম্যাপও ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে। প্রশ্ন উঠছে, এই দলগুলো এখন কেন রাজপথে নামছে? তারা বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করতে চাইছে কিনা, এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তাদের এই কর্মসূচি নেয়ার বিষয়কে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, সংস্কার বা জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলছে। কিন্তু আলোচনার টেবিল থেকে বিষয়টিকে রাজপথে আনা হচ্ছে; যা নির্বাচন প্রশ্নে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। তারা আরো বলেছেন, প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো ভোট পাবে না, ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এজন্য তারা পিআর পদ্ধতিতে ভোট চায়।
যদিও জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ইসলামী সমমনা দলগুলোর নেতারা এসব বক্তব্য মানতে রাজি নন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, সংস্কার বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা না হলে নির্বাচনের পর তা বাস্তবায়ন করা হবে কিনা, সেই সন্দেহ তাদের রয়েছে। সেজন্য জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে নির্বাচনের আগেই এর বাস্তবায়ন চাইছেন তারা এবং সমাধান না হওয়ায় তারা রাজপথে নামছেন।
এছাড়াও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও মব সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তাদের আরো অভিযোগ, ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপি ক্ষমতায় চলে গেছে এমন মনে করছে।
অভ্যুত্থান শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়নি বলেও মন্তব্য করছেন তারা। অন্যদিকে বিএনপির বিভিন্ন নেতা অভিযোগ করে আসছেন, প্রশাসনকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে জামায়াত। সব জায়গায় তাদের লোকজন বসিয়ে সুবিধা ভোগ করছে, বিএনপিকে চাপে রাখছে। এমনকি জামায়াত ও এনসিপিকে সরকার সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ তাদের।
তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবিতে জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে বিএনপি। দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়া এ নিয়ে নেতারা প্রকাশ্য মন্তব্য করতে চান না বলে একাধিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক দল তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারে। জামায়াত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে যেসব কর্মসূচি দিয়েছে, তা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য দিয়েছে বলে মনে করি। তাদের কর্মসূচি দেখেই আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করব।
ইসলামপন্থি দলগুলোর রাজপথের কর্মসূচিকে দুভাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন। তিনি মনে করেন, সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলে জামায়াত বলেছিল তারা সংস্কারের আগে নির্বাচন চায় না এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। একটা হতে পারে জামায়াত নির্বাচন চাচ্ছে না। কর্মসূচির মাধ্যমে সে ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার অতীতে দেখা গেছে, সরকার নিজের চাওয়া বাস্তবায়নে বিভিন্ন দলকে দিয়ে কখনো মব বা রাজপথে আন্দোলন করিয়ে চাপ সৃষ্টি করে থাকে।
গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় পার্টির (একাংশ) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি করেছে কিছু রাজনৈতিক দল। এ ধরনের দাবি শুধু অনভিপ্রেতই নয়, বরং সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বিপজ্জনক। যে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে জাতীয় পার্টি অতীতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল, সেই জামায়াত কীভাবে আজ জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে, তা জাতির কাছে বিস্ময়কর ও দুঃখজনক।
তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় পার্টি কখনোই কোনো রাজনৈতিক অপরাধে লিপ্ত হয়নি, কিংবা এমন কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়নি যাতে নিষিদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে থেকেই জাতীয় পার্টি বারবার জনগণের কল্যাণ, উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার পক্ষে কাজ করেছে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জাতীয় পার্টি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি এলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে, জনগণের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়। তাই এ ধরনের দাবি কেবল অযৌক্তিকই নয়, বরং দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জনগণের রায়ের প্রতি অবমাননা।