আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষমা চাইতে বলল যুক্তরাষ্ট্র হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৪ পিএম
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষমা চাইতে বলল যুক্তরাষ্ট্র হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ঠেকাতে না পারার অপরাধে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ক্ষমা চাইতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। সম্প্রতি সংগঠনটির বার্ষিক সাধারণ সভায় জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি এই দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিতে হলে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্ট ভাষায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং বাংলাদেশে ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু নির্যাতন হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। সভায় মহাসচিব গুতেরেসের উদ্দেশ্যে আরো বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ফলকার টুর্কের সতর্ক বার্তার মুখে নির্বাচিত সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করে দিয়েছিল ঠিক তেমনি দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনও চিরতরে বন্ধ করে দিতে তিনি যেন পরামর্শ দেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের ফ্লোরাল পার্কে গোল্ডেন ইয়ার্স কম্যুনিটি সেন্টারে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নবেন্দু দত্তের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণু গোপের সঞ্চালনায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে সভাটি চলে। সভায় সংগঠনের তিন সভাপতি ডা. টমাস দুলু রায়, ড. দ্বিজেন ভট্টাচার্য্য ও রণবীর বড়ুয়া এবং ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুশীল কুমার সাহা ছাড়াও প্রায় দেড়শ জনেরও বেশি সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
সভায় নিউইয়র্কের অন্যতম সংগঠন হিন্দু হেরিটেইজ অফ নিউইয়র্ক, ইউনাইটেড হিন্দুজ অফ ইউএসএ, বাংলাদেশে পূজা সমিতি, শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত সংঘ, গীতা সংঘ, রাধামাধম মন্দির, মহামায়া মন্দির, জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতা এবং সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা প্রদানে ড. ইউনূস সরকারের ব্যর্থতা ও অনীহার তীব্র নিন্দা জানান এবং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের কয়েকজন দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিককালে অত্যাচারের ঘটনাবলী বর্ণনা করা ছাড়াও ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে রামু, নাসিরনগর, মুরাদনগর, সাঁথিয়া, নানুয়ার দিঘীর পাড়সহ ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো কারা ঘটিয়েছিল এবং তাতে কোন সরকারের কী ভূমিকা ছিল সে ইতিহাসও নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তুলে ধরেন।
সভায় বক্তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সংখ্যালঘুদের ঘটনাকে অস্বীকার না করে ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপরাধে অপরাধী মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার, বিচার করাসহ ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস হওয়া সম্পত্তির জন্য ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বক্তারা আরো বলেন, নির্বাচনের পর সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত হেইট ক্রাইম ও স্পীচ আইন, ভারতের মত সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং ইসলামী ফাউন্ডেশনের আদলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি এবং ‘সেপারেট ইলেক্টরেট’ ব্যবস্থা সংযুক্ত করে একটি টেকসই ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করবেন, যার সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদ সরকারকে একটি খসড়া সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিল দিতে প্রস্তুত রয়েছে। বক্তারা ড. ইউনূসকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি যেন আগের তত্বাবধায়ক সরকারগুলোর মত দেশের সব রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে একটি সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। কারণ বৈষম্যমূলক আচরণ ও সহিংসতার অভিযোগে কেবল একটি বিশেষ দলকে বাদ দিয়ে, অন্যান্য দল যারা ১৯৭১ সালের গণহত্যা, আদিবাসী গণহত্যা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিরোধী দলের ওপর গ্রেনেড হামলা বা থানা দখল, লুটপাট, মেট্রো রেলে অগ্নি সংযোগ, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং পুলিশকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার মত অসংখ্য মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধে অপরাধী তাদের নিয়ে নির্বাচন করা অযৌক্তিক ও হাস্যকর। সেটা বিশ্বের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
এরআগে, সভার শুরুতেই সংখ্যালঘু নির্যাতনে নিহতদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রজ্বলনের সঙ্গে ‘দেখ আলোয় আলো আকাশ’ গানটি পরিবেশন করা হয়। এরপরই বাংলাদেশ থেকে সম্প্রতি নিউইয়র্ক সফরে আসা ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার অভিজিৎ ভট্টাচার্য ও নারায়ণগঞ্জের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর প্রদীপ ভৌমিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এসময় সভাস্থলে একটি পুস্তিকা বিলি করা হয়, যাতে নিহত-ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছাড়াও যশোরের অভয়নগর, রংপুরের গঙ্গাছড়া, চট্টগ্রামের হাজারিগলি, পার্বত্য চট্টগ্রামে গোটা বৌদ্ধ পাড়ার একশটি বাড়ি ও ক্রিসমাস ঈভে খৃষ্টান পাড়ার ১৭টি বাড়িকে অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা ও খাগড়াছড়ির গুইমারায় নাবালিকা ধর্ষণের প্রতিবাদরত তিন জন মারমা আদিবাসীকে হত্যার বিশদ বর্ণনা ছিল। সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণু গোপ গত এক বছরে বাংলাদেশের বিপন্ন সংখ্যালঘুদের সাহায্য ও সুরক্ষার্থে নানা উদ্যোগের বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ চন্দন সেনগুপ্ত গত এক বছরের হিসাব দাখিল করেন।
বক্তাদের মধ্যে ছিলেন শিতাংশু গুহ, ড. জিতেন রায়, ড. সব্যসাচী ঘোষ দস্তিদার, রূপকুমার ভৌমিক, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, প্রদীপ মালাকার, তপন সেন, রীণা সাহা, পার্থ তালুকদার, সুভাষ সাহা, নির্মল পাল, রমেশ নাথ, রণবীর বড়ুয়া, ড. টমাস দুলু রায়, ভজন সরকার, রামদাস ঘরামী, সুশীল সিনহা, নিতাই নাথ, বিশ্বজিৎ সাহা, রাজীব দে, এফ.শাওন দেবনাথ, এডওয়ার্ড হলসানা, পিয়াস কাঞ্চন দাশ, অঞ্জন চক্রবর্তী প্রমুখ। ২৬জন নবাগত তরুণ-তরুণী সদস্য তাদের অভিজ্ঞতা, আশা প্রত্যাশার কথা জানান সভায়।
