×

মুক্তচিন্তা

যৌন নিপীড়ন: আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

Icon

দীপ্তি রানী সিকদার

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৪ পিএম

যৌন নিপীড়ন: আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

যৌন নিপীড়ন ও হয়রানী প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে লিখেছেন দীপ্তি রানী সিকদার

সময়ের পরিক্রমায় নারীর আস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। পাশাপাশি সমাজের ভেতরে মূল্যবোধের অবক্ষয়ও দেখা যাচ্ছে। যার ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বিশেষ করে নারী ও কন্যার প্রতি যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকভাবে ঘটছে। নারী ও কন্যারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতাসহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসাবে যৌন সহিংসতাকে ব্যবহার করা হয়। নারীকে অবদমিত করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই প্রতিনিয়ত তাদেরকে যৌন সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। ছাত্র, তরুণ দেশের নাগরিকদের মধ্যে সকল ঘটনায় প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য লক্ষণীয় কোন উদ্যোগ দেখা যায় না, বরং তাদের মধ্যে উদাসীনতা লক্ষণীয়। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কথা নাই বলি।

নারায়ণগঞ্জের চারুকলার প্রতিবাদী ছাত্রীর কথা মনে আছে? ২০০২ সালে এলাকার বখাটে ছাত্রনেতা, এলাকার প্রভাবশালী মুরব্বী ও পুলিশ কর্মকর্তা যৌন হয়রানি শিকার হয়ে প্রতিবাদ করায় তার বাসায় গিয়ে তার বাবা-মাকে অপমানের প্রতিবাদে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বন্ধে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মতবিনিময় সভার আয়োজন, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যৌন নিপীড়ন নিরোধ আইন (খসড়া) প্রণয়ন করে জমা দিয়ে আইন প্রণয়নের জন্য ধারাবাহিকভাবে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বন্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের দিক নির্দেশনামূলক রায়ের বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটিতে সদস্য হিসাবে কাজ করছে। ধারাবাহিক কাজের অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেছি, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা তুচ্ছ ঘটনা হিসাবে দেখা হয়। ২০০৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ থেকে যৌন হয়রানির ও নিপীড়ন রোধে ১০(২)ধারা বাতিল করে দিয়ে তৎকালীন আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুল আহমেদ বললেন, কোন নারীর দিকে তাকালেই তাকে দুষ্টামির ছলে কিছু কথা বললেই কি যৌন হয়রানি হয় নাকি, এগুলো সামাজিকতার সম্পর্কের মাঝখানে হয়েই থাকে।  

নারী প্রতি যৌন সহিংসতা যে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ঢাকা স্ট্রিমের সংবাদকর্মীর আত্মহত্যা। বাস্তবকাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থী, শিক্ষিকা, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা নারী সহকর্মী, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দ্বারা সমমর্যাদার আরেকজন নারী সহকর্মীকে কিভাবে যৌন হয়রানি করছে এবং তারা কি ধরণের মানবিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তা অবর্ণনীয়। এই ধরণের সহিংসতা প্রতিকারের জন্য কোথায় যাবে, কি করবে সে বিষয়ে কোন তথ্য সহজে ভুক্তভোগী নারী পায় না। আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নির্যাতনের শিকার নারীকেই তার উপরে ঘটে যাওয়ার সহিংসতার বিচার প্রার্থী কি হবে, শুরু হয়ে যায় তাকেই বিভিন্নভাবে দোষারোপ করা এবং তাকেই নির্যাতনের জন্য দায়ী করা হয়। 

বর্তমান সময়ে তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্যাতনের শিকা নারীর প্রতি কুৎসা রটনা এবং নির্যাতনকারীকে হিরো বানানোর ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। কখনো কখনো নির্যাতনের শিকার নারী অথবা তার পরিবারের সদস্যরা বিচারপ্রার্থী হলেও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা তাদেরকে হতাশ করে এবং তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমরা নারায়ণগঞ্জে আর্ট কলেজের ছাত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনার ঘটনায় ২০০২ সালে পরিবার মামলা করে। এলাকার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশীল ও প্রশাসনিক ক্ষমতাধর পুলিশের প্রভাবে এখনো মামলা চলমান। বিচারপ্রার্থীর মা বিচারের আশায় থাকতে থাকতে মারা গেছেন। ঢাকা স্ট্রিম’র বাংলা বিভাগের প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের দ্বারা নারী কর্মকর্তা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। সংবাদকর্মীর বাবাও বিচার প্রাপ্তি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করছেন।  

২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে সুস্পষ্টভাবে যৌন হয়রানি কোন কোন বিষয়কে বলা হবে যেমন: শারীরিক স্পর্শের মত অপ্রত্যাশিত যৌনাকাঙ্ক্ষা ব্যবহার, প্রশাসনিক, কর্তৃত্বমূলক অথবা পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ বা চেষ্টা, যৌন ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন শারীরিক বা ভাষাগত আচরণ, যৌন সম্পর্কের দাবি বা অনুরোধ, পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা রসিকতা, অশালীন উক্তিসহ আপত্তিকর কোনো ধরণের কিছু করা, চিঠি, ই-মেইল, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, এসএমএস, পোস্টার, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, ব্ল্যাকমেইলিং এবং চরিত্র হনন-এর উদ্দেশ্যে স্থির বা ভিডিও চিত্র ধারণ, লিঙ্গীয় ধারণা থেকে বা যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে শিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতায় বাধা দেয়া, প্রেমের প্রস্তাব দেয়া এবং প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে চাপ সৃষ্টি ও হুমকি দেয়া, মিথ্যা আশ্বাস, প্রলোভন বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিটি কর্ম প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি গঠন করা এবং তাদের কার্যক্রম কিভাবে সে বিষয়েও দিক নির্দেশনা দেয়া আছে। দিক নির্দেশনা বলা হয়েছে-(ক)সরকারি-বেসরকারি সব কর্মস্থল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং সুপারিশমালা প্রস্তুতের জন্য একটি অভিযোগ কমিটি গঠন করবেন। (খ) অভিযোগ কমিটির সদস্য সংখ্যা হবে নুন্যতম ৫ জন যাহার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য নারী হইবেন। অভিযোগ কমিটির প্রধান নারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। (গ) অভিযোগ কমিটির সদস্যদের মধ্যে নুন্যতম ২ জন বহিঃস্থ সদস্য হইবেন। বহিঃস্থ সদস্যবৃন্দ জেন্ডার ইস্যু এবং যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কাজ করে এমন সংগঠনের হইবেন। (ঘ) অভিযোগ কমিটি সরকারের কাছে বাৎসরিক প্রতিবেদন জমা দিবেন।    

সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের রায় মেনে চলা বাধ্যতামূলক এবং এর আলোকে আইন তৈরি করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু দীর্ঘ দিন পরেও আইন করার জন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ মানবাধিকার সংগঠনের দাবি ও আইনের খসড়া প্রস্তাবনা জমা দিয়ে অ্যাডভোকেসি করা হলেও কি এক অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রভাবে এখনো আইন করা সম্ভব হয়নি, তা বোধগম্য নয়। এখন পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, এমন কি সচিবালয় ও মহামান্য হাইকোর্টের দিক নির্দেশনামূলক রায়ের আলোকে কমিটি গঠন হয়নি। সে সকল প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন হয়েছে তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা এই বিষয়ে কোন মনিটরিং সিস্টেম নাই। 

দুঃখজনক হলেও সত্য এখনো আমাদের সমাজে নারী ও কন্যার প্রতি যৌন হয়রানি ও নিপীড়নকে  নিছক মজা, নিরীহ রোমান্টিকতা অথবা বয়সজনিত চপলতা হিসাবে বিবেচনা করে থাকে ফলে  এ ধরনের আচরণ যে একজন নারীর মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে তা আমলেই নেন না। যার ফলে সমাজের দ্বারা প্রতিরোধে উদাসীনতা লক্ষণীয়। বর্তমান সহিংস আচরণ নারীর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি তৈরি করছে। যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নারীর মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে। নারী ও কন্যার প্রতি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই ধরনের সহিংসতা ও প্রতিরোধ ও প্রতিকারে চাই যুগোপযোগী আইন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। যৌন নিপীড়ন ও যৌন হয়রানিকারীদের শাস্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সামাজিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এদেরকে বয়কট করা সময় এখন-ই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আবারও কমল স্বর্ণের দাম

আবারও কমল স্বর্ণের দাম

ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুললেন সিটি’র শিক্ষার্থীরা

ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুললেন সিটি’র শিক্ষার্থীরা

সালমান শাহ হত্যা মামলা: খোঁজ মিলছে না সামিরার

সালমান শাহ হত্যা মামলা: খোঁজ মিলছে না সামিরার

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে সরকার প্রস্তুত: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে সরকার প্রস্তুত: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App