ব্যাংক খাত
ধসের মুখে ইসলামী ব্যাংকও
মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:২৯ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
দেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ছিল প্রথম সারির একটি ব্যাংক। সরকার পরিবর্তনের পরপরই ব্যাংকটির মালিকানা নিয়েও চলে টানাপড়েন, একই সঙ্গে আর্থিক সূচকগুলো ধারাবাহিকভাবে পতন হতে শুরু হয়। এতে গ্রাহকের মাঝে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় ব্যাংকটি ধসে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গ্রাহক ও বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকটির ভেতরে নানা ধরনের রাজনৈতিক কোন্দল চলছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দখলের নাম আসায় গ্রাহকের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর ফলে দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাতে বসেছে ব্যাংকটি; দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি সময় প্রথম অবস্থানে থাকলেও এখন সর্বনিম্ন স্থানে জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে আছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। এরপর রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে এসে ঠেকছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ছাঁটাই করা কর্মীদের মানববন্ধন চলাকালীন দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকদের ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এতে গ্রাহকরা টাকা তুলতে না পেরে চলে যেতে বাধ্য হন। ফলে গ্রাহকদের মাঝে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাংকটিকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। যে কোনো সময় সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে একসঙ্গে টাকা তোলার হিড়িক পড়তে পারে।
সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ আসার কারণে ব্যাংকের মধ্যে অনেক অস্থিরতা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান এমডি ওমর ফারুক খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুদকে একাধিক মামলাও রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছেন তিনি।
ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিসের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও সবশেষে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ওমর ফারুক খান। সেই সময়ে ১ হাজার ৯২ কোটি আত্মসাতের অভিযোগে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক, সাবেক এমডিসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলায় তিনিও আসামি রয়েছেন। তিনি এস আলম ও নাসা গ্রুপ এবং নাবিল গ্রুপকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ দিয়েছেন। নাসা গ্রুপকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়ার কারণে ২০২২ সালে তার চাকরি চলে যায়। পরে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার পুরস্কার হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ পতনের পর তিনি আবার ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেন।
সূত্রে জানা গেছে, আওয়াম লীগ পতনের পর ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান এমডি ওমর ফারুক খান আওয়ামী লীগবিরোধী ও সংস্কারপন্থি হিসেবে নিজেকে জাহির করছেন। সম্প্রতি ব্যাংক থেকে হঠাৎ পাঁচ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছেন আওয়ামী লীগ ও এস আলম আলম গ্রুপের লোক বলে। এতে ব্যাংকটির মধ্যে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। হঠাৎ ৫ হাজার লোককে একসঙ্গে চাকরি থেকে বাদ দেয়াটা বাংলাদেশ ব্যাংকও ভালোভাবে নেয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিষয় নয়। তবে অতীতে কেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়া কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এবং এখন কেনই বা কর্মী ছাঁটাই করার জন্য মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, এ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠতে পারে। হঠাৎ এত লোকের চাকরি একসঙ্গে বাদ দেয়াটাও ঠিক হচ্ছে না।
জানা গেছে, চলতি ২০২৫ হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির মুনাফা কমেছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। ব্যাংকটির আলোচিত হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সমন্বিত মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৬২ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে যা হয়েছিল ১ টাকা ৬৬ পয়সা। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের সমন্বিত ইপিএস কমেছে ১ টাকা ৪ পয়সা বা ৬২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এদিকে চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকের সমন্বিত ইপিএস হয়েছে ২০ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সমন্বিত লোকসান হয়েছিল ৫৫ পয়সা। চলতি হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সমন্বিত নগদ পরিচালন প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ১২ টাকা ৪৪ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে যা ৩ টাকা ২ পয়সা ঋণাত্মক হয়েছিল। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সমন্বিত নিট সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ৪৪ টাকা ৪৮ পয়সা। আগের বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ৪৫ টাকা ৩৭ পয়সা।
জানা গেছে, প্রায় পাঁচ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই এবং একই পদে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর অভিযোগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে তলব করেছেন ঢাকার আদালতে। মামলার আরজিতে বাদীরা বরখাস্তের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা, নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা, এবং বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের সম্পূর্ণ বেতন-ভাতাসহ পুনর্বহাল করার নির্দেশনা চেয়েছেন। এছাড়া, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক যেন ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখে এমন নির্দেশনা দেয়ার আবেদনও করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানার জন্য ইসলামী ব্যাংকের এমডি ওমর ফারুক খানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
