বাতাস দূষণের মাত্রা শীতে আরো বাড়বে
সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০১:০৪ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নেয়ার সৌভাগ্য অনেক আগেই খুইয়েছে ঢাকাবাসী। সারা বিশ্বের মধ্যে বায়ুদূষণে ঘুরেফিরেই শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম। নাগরিক জীবনে যানজট, শিল্পায়ন ও বিভিন্ন প্রকারের দূষিত পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বায়ুর মান ক্রমশ কমছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অকালমৃত্যু; স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর হারও।
এদিকে তথ্য বলছে, বায়ুর গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়। শীতে বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসে ঢাকার বায়ু সবচেয়ে বেশি দূষিত থাকে। বিগত ৯ বছরের ডিসেম্বর মাসগুলোর মধ্যে সবশেষ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ছিল ঢাকায়। তাছাড়া ২০১৬-২৪ সময়ের মধ্যে গত বছর ছিল সর্বাধিক দূষণের বছর।
দূষিত শহরের তালিকায় ৬ষ্ঠ ঢাকা : বৃহস্পতিবারও ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ঢাকার বাতাস। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে বায়ুদূষণে বিশ্বের শহরগুলোর তালিকায় ১৫৭ স্কোর নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল ৬ষ্ঠ। বাতাসের এই মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়েছে, যা সবার জন্যই ক্ষতিকর এবং বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর (শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি) জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
গত বুধবার আইকিউএয়ারের ঢাকার গড় বায়ুমান ছিল ১৬২। ঢাকার অবস্থান ছিল ৭ম। ২৮ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ৪র্থ অবস্থানে ছিল ঢাকা। ২৮ তারিখ ঢাকার স্কোর ছিল ১৯৩, ২৭ তারিখ ১৬১; ২৬ তারিখ ১৬৩ স্কোর ছিল ঢাকার। ২৫ ও ২৪ তারিখ ঢাকার অবস্থান ছিল ৬ষ্ঠ। ২৫ তারিখ ১৪৯ স্কোর আর ২৪ তারিখ স্কোর ছিল ১৫৮। ২৩ তারিখ ঢাকার বাতাসের মান ছিল ১৫৭, বিশ্বের ১২৫ শহরের মধ্যে ৭ নম্বরে ছিল। ২২ তারিখ বিশ্বের ১২৫ শহরের মধ্যে ৮ নম্বরে ছিল ঢাকা। স্কোর ছিল ১৫৭। ২১ তারিখ ১৩৯ স্কোর নিয়ে ৯ম অবস্থানে ছিল ঢাকা।
আইকিউএয়ারের সূচক অনুযায়ী, শূন্য থেকে ৫০ স্কোর মানে বাতাস ভালো, ৫১ থেকে ১০০ স্কোরে বাতাস মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর বাতাসকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর করে তোলে। এই পর্যায়ে সংবেদনশীল ব্যক্তিদের দীর্ঘ সময় বাইরে পরিশ্রম না করার পরামর্শ দেয়া হয়। ১৫১ থেকে ২০০ স্কোরের মধ্যে থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২ দশমিক ৫-এর উপস্থিতি, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত দৈনিক নির্দেশিকা মানের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি। বাংলাদেশে আইকিউআই সূচক নির্ধারিত হয় পাঁচ ধরনের দূষণের ভিত্তিতে- বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ওজোন।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব : ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ফুসফুসের রোগের সঙ্গে ক্যানসারজনিত মৃত্যু ১৪ শতাংশ বাড়ে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বব্যাপী শুধু ২০২১ সালেই ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। আর বাংলাদেশে এই মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু ২ বছর ৪ মাস কমছে। অন্যপক্ষে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস এবং সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা আয়ু হারাচ্ছেন গড়ে প্রায় ৮ বছর। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ফিরোজ খান জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে অকালমৃত্যুর ২০ শতাংশই হয় বায়ুদূষণজনিত রোগের কারণে। বায়ুদূষণ-সংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় দেশের জিডিপির অন্তত ৪ থেকে ৫ শতাংশ ব্যয় হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ২০২৩ সালে ‘ঢাকায় বায়ুদূষণ ও গর্ভাবস্থার ফলাফল’ শিরোনামে এক গবেষণা করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
সেই গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় সন্তানসম্ভাবা মায়েদের ওপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি। ২০২৩ সালে এক সংলাপে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বায়ুদূষণের ফলে চিকিৎসায় একজন মানুষকে বছরে ৪ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
চলতি বছরের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিরো কার্বন অ্যানালাইটিকসের (জেডসিএ) প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বায়ুদুষণে শিশু মৃত্যুর ঘটনা নীরব মহামারি হয়ে উঠেছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। বিশ্বে এ বয়সে যত শিশু মৃত্যু ঘটে তার এক-চতুর্থাংশেরও বেশির জন্য দায়ী বায়ুদূষণ।
আর এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উন্নত দেশের শিশুদের তুলনায় স্বল্পোন্নত দেশের শিশুদের বায়ুদূষণে মৃত্যুর ঝুঁকি ৯৪ গুণ বেশি। এই বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে দীর্ঘদিনের জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা, দূষণনির্ভর অবকাঠামো নির্মাণ, জীবাশ্ম জ্বালানির বেশি ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতাকে দায়ী করেছেন গবেষকরা।
বায়ুদূষণ রোধে ৯ নির্দেশনা ৩ সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়ন চান হাইকোর্ট : এদিকে বায়ুদূষণ রোধে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি বলে নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বায়ুদূষণ রোধে এর আগে দেয়া ৯ নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে নির্দেশনায়। একই সঙ্গে নির্দেশনা আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়ন করে বিবাদীদের আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আগামী ৩০ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান এবং বিচারপতি উর্মি রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ সময় আদালত বর্তমানের বায়ুদূষণের পরিস্থিতি ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। পরিবেশের পক্ষে আইনজীবী মুনতাসির উদ্দিন, উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী মো. শাহজাহান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী খসরুজ্জামান এবং ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুরশিদ আক্তার।
মনজিল মোরসেদ জানান, সম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়াই এ-সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। আবেদনটি পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী দায়ের করেন। সেই আবেদনে শুনানি নিয়ে ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধে আদালতের ৯ দফা নির্দেশনা ৩ সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দূষণের উৎস বন্ধে অগ্রগতি নেই
বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের জন্য দায়ী শহরের আশপাশের ইটভাটাগুলো। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত থাকলেও এখনো অনেক ইটাভাটা অনুমোদনবিহীনভাবে চলছে। তাছাড়া পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা হলেও এর প্রচলন নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া শহরে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এছাড়া বায়ুদূষণের অন্যতম অনুষঙ্গ নির্মাণকাজ। প্রতিদিন চলতি পথে রাস্তার পাশে নির্মাণকাজের ইট-বালু-সুরকির স্তূপ হয়ে থাকতে চোখে পড়ে। সেগুলো গড়িয়ে পড়ছে রাস্তার ওপর।
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও স্তূপ করে রাখা মাটিও বায়ুদূষণের বড় উৎস। ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে রিট করলে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করে। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ৯ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকা শহরে মাটি/বালি/বর্জ্য পরিবহনকৃত ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা, নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি/বালি/সিমেন্ট/পাথর/নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক রাস্তায় পানি ছিটানো, রাস্তা/কালভার্ট/কার্পেটিং/খোঁড়াখুঁড়ি কাজে টেন্ডারের শর্ত পালন নিশ্চিত করা।
এছাড়া কালো ধোঁয়া নিঃসরণকৃত গাড়ি জব্দ করা, সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও উত্তীর্ণ হওয়া সময়সীমার পরে উক্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ করা, অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করা, পরিবেশ লাইসেন্স ব্যতীত চলমান সকল টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা, মার্কেট/দোকানগুলোতে প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং অপসারণ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নেয়া। অথচ এসব ক্ষেত্রে কাউকেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, চাইলেও বায়ুদূষণ পুরোপুরি দূর করা যাবে না। তবে বেশি দূষণের এলাকায় মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। এটাও মনে রাখা দরকার যে মাস্ক বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষা দেয়।
পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ সবচেয়ে বেশি হয়। এর মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও লাং ক্যানসার, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা অন্যতম। বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টিও জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে; কিন্তু তা কতটা মানসম্মত সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত। এই পরিবেশবিদ বলেন, বায়ুদূষণের বড় কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি। আমাদের দেশে ইটভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হতো। তবে সেটা হয়তো কিছুটা কমছে; কিন্তু আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সেটা না হলে ব্যক্তিগত গাড়ি কমবে না, এ ধরনের জ্বালানির ব্যবহারও কমবে না।
