কড়াইল বস্তির বাতাসে দীর্ঘশ্বাস
আজিজুর রহমান জিদনী
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪১ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
কড়াইল বস্তিতে গত ২০ বছর ধরে জয়নালের ঘরে ভাড়া থাকেন শারমিন বেগম। স্বামী আজাহার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে চাকরি করেন। সংসারের সচ্ছলতা আনতে শারমিনও চাকরি নেন একটি গার্মেন্টস কারখানায়। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় আপাতত চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
গত মঙ্গলবার আগুন লাগলে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান জয়নাল। চোখের সামনে সাজানো সংসারের সব আসবাব ছাই হয় তার। শারমিন কাঁদতে কাঁদতে এ প্রতিবেদককে জানান, ২০০৪ ও ২০১৭ সালের আগুনেও নিঃস্ব হয়েছিলেন তিনি। সেই দুই আগুনে দুবার ঘুরে দাড়িয়ে এবারো সবকিছু হারিয়ে এখন পথে বসেছে এই পরিবারটি। গত কয়েক বছরে স্বামী-স্ত্রী চাকরির টাকায় সংসারে যত আসবাব গড়েছেন, সব পুড়ে গেছে।
আগুন লাগার প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর রাজধানীর কড়াইল বস্তির আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপন হলেও রেখে গেছে এর ভয়াবহতার ছাপ। সর্বগ্রাসী আগুনে বস্তিতে থাকা খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অধিকাংশই সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। বছড়জুড়ে কষ্টার্জিত আয়ে গড়ে তোলা আসবাব ও স্বর্ণালংকারসহ কোনো মালামালই রক্ষা করতে পারেননি অনেকেই। সরজমিনে গিয়ে গতকাল বুধবার দেখা যায়, কড়াইল বস্তির আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে সাহায্যের আশায়। শীতের মধ্যে পরিবারগুলো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে। গত মঙ্গলবারের আগুনে এমন পরিবারও রয়েছে- যারা ওই বস্তিতে এর আগে যতবারই আগুন লেগেছে ততবারই সবকিছু হারিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিলি ডিফেন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কড়াইল বস্তিতে আগুনে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে।
এক বছর আগে দানের টাকার ১৫-১৬ লাখ টাকা ব্যয় করে কড়াইল বস্তির জামালের বাজার ইউনিট অংশে দারুল নাজাত মহিলা মাদ্রাসা ও কিন্ডার গার্ডেন গড়ে তোলেন মাওলানা মো. উল্লাহ। বস্তির নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করত। ৩৬ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিধি এগিয়ে যাচ্ছিল বড় হওয়ার দিকে। কিন্তু গত মঙ্গলবার ভয়াবহ আগুনে পুরো মাদ্রাসাটি পুড়ে গেছে। মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মো. উল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, তিনি বনানীতে একটি মসজিদে নামাজ পড়ান। পাশাপাশি মাদ্রাসাটি পরিচালনা করেন। ১ বছর আগে মাদ্রাসটি গড়ে তুলেছেন। কম বেতনে এখানে বস্তির নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর লক্ষ্যে কিছু শিক্ষকও নিয়োগ দেন। আগুন যখন লাগে তখন শিক্ষকরা ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষায় প্রাধান্য দিয়ে তাদের নিয়ে কোনো রকমে বের হয়ে যান। ফলে মাদ্রাসার কোনোকিছুই রক্ষা করা যায়নি। মাদ্রাসাটি বহু কষ্টে দান-ছদকার টাকায় নির্মিত হয়েছিল। এখন মাদ্রাসাটি আবার কীভাবে নতুনভাবে গড়বেন সে চিন্তায় রয়েছেন বলে জানান।
চোখের পলকেই আগুন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে জানিয়ে বস্তির বাসিন্দা রাজিব হোসেন বলেন, চোখের পলকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে ছোট একটি আগুন দেখেছিলাম, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ঘরে লেলিহান শিখা ছড়িয়ে যায়। চারদিক ধোঁয়া আর আগুনে অন্ধকার হয়ে আসে। তখন আর কিছু বাঁচানোর মতো সময় ছিল না। প্রাণ বাঁচাতে সবাই কোনো রকমে বাইরে বেরিয়ে আসি। কেউই কল্পনা করতে পারেনি এত দ্রæত সব শেষ হয়ে যাবে। বাইরে এসে দাঁড়িয়ে শুধু আগুনে পুড়তে থাকা ঘর দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা বেগম চাকরি করেন গার্মেন্টসে। স্বামী কাজি মিয়া গাড়িচালক। আগুনে শারমিনের মতো সুরমা বেগমও এক কাপড়ে জীবন নিয়ে বের হয়ে গেছেন। কোনো আসবাব রক্ষা হয়নি। এখন খোলা আকাশের নিচে সন্তানসহ অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটছে। তিনি জানান, এবারই প্রথম নয়; ২০১৭ সালের আগুনেও সবকিছু হারিয়েছেন তিনি। এভাবে বারবার আগুন লাগে আর তারা নিঃস্ব হন। এবার নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কিনা- বলে কাঁদতে শুরু করেন।
গত মঙ্গলবার বৌবাজারের একটি ঘর থেকে বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিশাল এই বস্তির সহস্রাধিক ঘরে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেও সরু পথ ও পানির সংকটে আগুন নেভাতে ব্যাপক বাধার মুখে পড়তে হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে ফায়ার সার্ভিস আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায়।
গত মঙ্গলবার রাতে কড়াইল বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ঘটনাস্থল থেকে আগুনের সর্বশেষ তথ্য জানাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেন্টেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বস্তিতে কথা বলে আমরা জানতে পেরেছি আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তদন্তের পর জানা যাবে আসলে কত ঘরবাড়ি পুড়েছে। তিনি আরো বলেন, আগুন লাগার ৩৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় তিনটি স্টেশনের ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট, ওই সময় সড়কে অনেক যানজট ছিল। এরপর আরো ইউনিট এলেও বড় গাড়িগুলো ঢুকতে পারেনি সরু রাস্তার কারণে। অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। তবে এখানে পৌঁছানোর আগেই আগুন ডেভেলপ স্টেজে চলে যায়। এ কারণে একটু সময় লেগেছে নিয়ন্ত্রণ আনতে।
