চট্টগ্রাম বন্দর: রাখঢাকে প্রশ্ন, বাড়ছে উত্তাপ
সমরেশ বৈদ্য, চট্টগ্রাম থেকে
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:০০ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
উন্মুক্ত কোনো টেন্ডার হয়নি। আগে থেকে কোনো জনসমীক্ষাও হয়নি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি গুরুত্বপূর্র্ণ টার্মিনাল দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় না রেখেই ছেড়ে দেয়া হয় বিদেশিদের হাতে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, বন্দর ব্যবহারকারী ও দেশের বিশিষ্টজনদের মতামতকে উপেক্ষা করেই গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে নির্মিতব্য কন্টেইনার টার্মিনাল ও ঢাকার অদূরে পানগাঁওয়ের কন্টেইনার টার্মিনাল দুটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে অন্তর্বর্তী সরকার।
শুধু তাই নয়, লালদিয়া এবং পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া দুই বিদেশি কোম্পানি আগামী ১০ বছরব্যাপী ১০০ শতাংশ করমুক্ত সুবিধাও পাবে চুক্তি অনুযায়ী। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নীতিমালা অনুযায়ী এই চুক্তি ‘নন-ডিসক্লোজার’। অর্থাৎ চুক্তিতে কী আছে তা জনগণ জানতে পারবে না।
এ নিয়ে আগামীকাল ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ মুখগুলোতে যে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)- তা অব্যাহত রয়েছে। গত সোমবার (২৪ নভেম্বর) বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের আলোচনা হলেও তেমন ফলপ্রসূ কিছু না হওয়ায় বন্দর অবরোধের ঘোষণা থেকে এক পা-ও পেছাবে না শ্রমিক সংগঠনগুলো। ফলে এ নিয়ে একধরনের সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে; যদি সরকার কোনো কঠোর পদক্ষেপে যায় এই অবরোধ ঠেকাতে।
তবে এর মধ্যে চট্টগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে বন্দরের টার্মিনাল ইজারা দেয়ার তীব্র বিরোধীতা করেছেন। তারা বলেছেন, একটি অন্তর্বর্তী সরকার এমন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখে না। দ্রুততার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন জাতির মনে গভীর সন্দেহ তৈরি করেছে। এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। গত ২০ নভেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় সম্পদ। তাই বন্দর পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তা জাতির সামনে খোলাসা করা উচিত। এর আগে জনগণের মতামত উপেক্ষা করে বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত জনরোষের মুখে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।
ইতোপূর্বে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর সম্পদ রক্ষা কমিটি’ নামে যে একটি সংগঠন ছিল; তাদের কোনো তৎপরতা এখনকার এই সংকটকালীন সময়ে চোখে পড়েনি। সেই সময়ে এই সংগঠনটি লাল পতাকা-ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল। কিন্তু সেসব নেতা ও সংগঠকদের কোনো কর্মসূচি বা বিবৃতিও চোখে পড়ছে না। ফলে সে সময়কার তাদের সেই আন্দোলন নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
শুধু এই লালদিয়া ও পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল দুটি নয়; বন্দরের এনসিটিসহ আরো কয়েকটি টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেয়ার নানা প্রক্রিয়া চলছে। বন্দরের লাভজনক টার্মিনালগুলোকে একের পর এক বিদেশিদের কাছে ইজারা দেয়ার বিষয়টিকে অনেকেই সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষে আগমন ও তার পরবর্তীতে ব্রিটিশদের এই পুরো ভারতবর্ষ দখল ও শাসনের সঙ্গে তুলনা করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে এই অসম চুক্তি বাতিল দাবিতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রমিক ও রাজনৈতিক সংগঠন তীব্র বিরোধীতা করে আসছে। স্কপ ইতোমধ্যেই আজ বুধবার চট্টগ্রাম বন্দরের সব প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ লক্ষ্যে তারা সাংগঠনিক কাজও গোছাচ্ছে।
অবরোধ সফলে মশাল মিছিল : চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়ার চর ও পানগাঁও টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে মশাল মিছিল ও গণসমাবেশ করেছে ‘বন্দর রক্ষা ও করিডরবিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম’। এতে বক্তারা বন্দর রক্ষায় শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ডাকা অবরোধ কর্মসূচিতে পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেছেন, দেশের সম্পদ চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার এখতিয়ার অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। জনমত উপেক্ষা করে গায়ের জোরে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সম্পদ নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলছে, এই খেলা তাদের বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মতো সর্বস্তরের জনতাকে রাজপথে নেমে তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে।
এদিকে, সোমবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর আমতলা মোড়ে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক জাবেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শ্রমিক নেতা ফজলুল কবির মিন্টু, ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি টিকলু কুমার দে, যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সহসভাপতি রুপম কান্তি ধর, সাংস্কৃতিক সংগঠক শিমুল সেন, শ্রমিক নেতা আবু বকর সিদ্দিকী প্রমুখ।
আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি, স্কপের অবরোধ বুধবার : চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে অবরোধ কর্মসূচি পরিস্থিতিতে আন্দোলনরত দুটি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে বৈঠকে ফলপ্রসূ কোনো আলোচনা ও সিদ্ধান্ত না হওয়ার কথা জানিয়ে অবরোধ কর্মসূচিতে অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)। সোমবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পরিষদ এবং এরপর স্কপ নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন বন্দরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (প্রকৌশল) কমডোর কাওছার রশিদ।
জানা গেছে, বন্দর কর্তৃপক্ষ উভয় সংগঠনকে একসঙ্গে বৈঠকে বসার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীদের মূল সংগঠন স্কপ নেতারা এতে আপত্তি জানান। বন্দর নিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে হঠাৎ ‘চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পরিষদ’ ব্যানারে ‘মহলবিশেষের’ সক্রিয় হওয়াকে স্কপ সন্দেহের চোখে দেখছে। ফলে তারা আলাদাভাবে বৈঠকের প্রস্তাব দিলে বন্দর কর্তৃপক্ষ তাতে সম্মতি দেয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কমডোর কাওছার রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনকারী দুটি পক্ষের সঙ্গে আমরা আলাদাভাবে বসেছিলাম। আমরা তাদের বলেছি, আমাদের পোর্ট চালাতে হবে, যে কোনোভাবে আমাদের পোর্ট চালাতে হবে। বন্দরের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। তাদের বিবেচনা করতে বলেছি। তারা খুব পজেটিভ। দেখা যাক কী হয়!
উল্লেখ্য, গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩৩ বছরের চুক্তি করেছে সরকার। এই মেয়াদ আরো ১৫ বছর বাড়ানোর সুযোগ আছে চুক্তিতে। একইদিন কেরাণীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল ২২ বছর মেয়াদে পরিচালনার জন্য সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এছাড়া বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালও (এনসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত আছে সরকারের।
জানা গেছে, বৈঠকে স্কপের পক্ষে টিইউসি নেতা ও শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য তপন দত্ত, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহারসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেতারা অংশ নেন। বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে তপন দত্ত বলেন, বৈঠকে তারা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। তবে চুক্তি-সংক্রান্ত কিছু খোলাসা করেননি। আমাদের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য তারা কোনো চাপ দেননি। এটা শুধু বলেছেন- বন্দরের ক্ষতি হয় এমন কিছু যেন না করি।
তাই এ অবস্থায় পূর্বঘোষিত অবরোধ কর্মসূচিতে অনড় থাকার কথা জানিয়ে তপন দত্ত বলেন, বৈঠকে যেহেতু ফলপ্রসূ কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত আছে। আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে বামপন্থিরা যুক্ত হয়েছেন, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবীরা যুক্ত হয়েছেন। ছাত্র, যুব, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিকরাও যুক্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় আমাদের পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পরিষদের পক্ষ থেকে সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসান মারুফ রুমী, সদস্য সচিব ও বিভাগীয় শ্রমিক দলের সদস্য মো. হুমায়ুন কবীর, নাগরিক ঐক্যের স্বপন মজুমদার এবং গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সমন্বয়ক চিরন্তন চিরু অংশ নেন। ‘চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পরিষদের’ আহ্বায়ক ও গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য হাসান মারুফ রুমী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বৈঠকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তারা এনসিটি ও সিসিটি ইজারার প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে না। আমরা এতে আশ্বস্ত হয়েছি। এজন্য আপাতত আজকের অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করেছি। আগামী ২৬ নভেম্বর পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা নতুন কর্মসূচি দেবেন বলে ভোরের কাগজকে জানান তিনি।
শ্রমিক ৯০ শতাংশ বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা শ্রমিক নেতাদের : চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে শ্রমিক নেতারা বলেছেন, বন্দর বিদেশিদের হাতে গেলে দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে যাবে এবং বন্দরের ৯০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। গত ২২ নভেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে চট্টগ্রামে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের বিভাগীয় কনভেনশনে বক্তারা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি ব্যবস্থাপনায় দিলে জাতীয় নিরাপত্তা, বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও শ্রমবাজার- সবই ঝুঁকির মুখে পড়বে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী ২৬ নভেম্বর জেলায় জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন শ্রমিক নেতারা।
তারা বলেন, বন্দর পরিচালনা ও উন্নয়নকে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করলে কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা থাকবে না। স্থানীয় শ্রমিকদের পরিবর্তে আউটসোর্সিং ও বিদেশি কর্মী ব্যবস্থাপনা বাড়বে- যা সামগ্রিক শ্রমবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। জাতীয় শ্রমিক জোট চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক জাহিদ উদ্দিন শাহিন অভিযোগ করে বলেন, মা, মাটি, মোহনা বিদেশিদের দেব না। বন্দর বিদেশিদের দিলে ৯০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে।
চুক্তি বিরোধীতায় চট্টগ্রামের ১০ বিশিষ্টজনের বিবৃতি : এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি অপারেটরের কাছে হস্তান্তর-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক দুটি চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছেন চট্টগ্রামের ১০ বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিদাতারাা চুক্তির টার্মিনেশন, ক্ষতিপূরণসহ আর্থিক শর্ত গোপন রাখা হলো কেন, এ প্রশ্ন তোলেন। তারা এসব তথ্য প্রকাশ্যে আনতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। নিউমুরিং টার্মিনালটি দেশীয় জনবল দিয়ে লাভজনকভাবেই পুরোদমে চালু আছে। বর্তমানে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করছে। প্রশ্ন হলো লাভজনকভাবে চালু টার্মিনালটি কেন আমরা বিদেশিদের দেব, যেখানে কোনো নতুন বিনিয়োগের সুযোগ নেই।
বিবৃতিদাতারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে বন্দর পরিচালনার মতো জাতীয় স্বার্থ জড়িত চুক্তি শুধু নির্বাচিত সরকারই করতে পারে। ফেব্রæয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকায় তার আগেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া অযৌক্তিক।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, লেখক ফেরদৌস আরা আলীম, নাট্যজন শিশির দত্ত, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি ওমর কায়সার, কবি কামরুল হাসান বাদল, লেখক ও উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব কমল সেনগুপ্ত, ভাস্কর অলোক রায় ও আইবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার।
লালদিয়া ও পানগাঁওয়ে বিনিয়োগকারীরা পাবেন ১০ বছর করমুক্ত সুবিধা : গত ১৯ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন- লালদিয়া এবং পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া দুই বিদেশি কোম্পানি আগামী ১০ বছরব্যাপী ১০০ শতাংশ করমুক্ত সুবিধা পাবে। তবে এই সুবিধা কোনো নতুন প্রণোদনা নয়- এটি সরকারের আগের আদেশ অনুযায়ী দেয়া হচ্ছে। সেদিন রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো নিয়ে কয়েকদিন ধরে দেশে বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ না করা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা এসব চুক্তি থেকে কী পাচ্ছি এবং কী ধরনের রেয়াত দিচ্ছি- এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। পাশাপাশি জন-আলোচনাও হওয়া উচিত। করছাড় পুরোপুরি প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। তবে এসব ছাড় অবশ্যই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নির্দেশনা অনুযায়ী হতে হবে বলেও মত দেন তিনি।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী কী বলেন : বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের সিইও আশিক চৌধুরী তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, কোনো সরকারই মূল পিপিপি চুক্তিপত্র আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে প্রকাশ করে না। সরকারি ক্রয়নীতি ও পিপিপি গাইডলাইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ চুক্তি প্রকাশ নিরাপদ নয়, কারণ এতে ভবিষ্যৎ বিডিং প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি আরো বলেন, সবকিছু প্রকাশ করলে ভবিষ্যতের সব আলোচনায় আমরা দুর্বল হয়ে যাব। তাছাড়া পিপিপি চুক্তিতে ব্যবসায়িক তথ্য ও অপারেশনাল কৌশল থাকে- যা গোপনীয়তার আওতায় সুরক্ষিত। বিশ্বব্যাংক ও এডিবিসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও পূর্ণাঙ্গ চুক্তি নয়, বরং সারাংশ প্রকাশের পরামর্শ দেয়।
বন্দর ব্যবহারকারীদের বক্তব্য : তবে পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ বলেন, এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে সবাইকে না জানিয়ে এই চুক্তিগুলো করা হচ্ছে। দেশের ভালো তো সবাই চায়। ফলে রাজনৈতিক দল, স্টেকহোল্ডার সবার সঙ্গে আলোচনা করে যেটা ভালো হয় সেটা করা দরকার। স্বচ্ছতা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, যাদের সঙ্গে চুক্তি হবে বা হচ্ছে তারা বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান। তারা যদি আমাদের বন্দরে আসে আমাদের দক্ষতা বাড়বে। তারা আধুনিক ইকুইপমেন্ট নিয়ে আসবে। ফলে আমরা শিখতে পারব। কিন্তু সেটা কীভাবে তারা করবে। চুক্তি কী, তা প্রকাশ্য হওয়া উচিত। আর কোনো দরপত্র ছাড়াই ডিপি ওয়ার্ল্ড এর সঙ্গে যে চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে তাও ঠিক হয়নি, দরপত্রের মাধ্যমে হলে ভালো হতো, বলেন পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক মাহমুদ।
