×

ঢাকা

ইলিশের বদলে কারাবাসে মৃত্যুর স্বাদ নিলেন মজিবর

Icon

সুরেশ চন্দ্র রায়, মানিকগঞ্জ থেকে

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫৩ পিএম

ইলিশের বদলে কারাবাসে মৃত্যুর স্বাদ নিলেন মজিবর

মজিবুর রহমান। ছবি : ভোরের কাগজ

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের সাতুরিয়া গ্রামের মজিবুর রহমান (৫৫) ছিলেন শতভাগ খেটে খাওয়া একজন সাধারণ মানুষ। তার জীবনের গল্পে ছিল না কোনো রোমাঞ্চ, ছিল না রাজনীতি বা বিত্তের আভিজাত্য। ছিল শুধু টিকে থাকার এক অনন্য লড়াই। যেখানে শ্রম ছিল একমাত্র মূলধন, আর আশাই ছিল একমাত্র পুঁজি।

মজিবর রহমানের সংসারে রয়েছেন স্ত্রী রিতা বেগম। ছেলে অন্তর ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মাস শেষে ঢাকার খরচ মিটিয়ে অল্প কিছু টাকা পাঠান ঘরে। মেয়ে অন্তরা একজন স্কুলশিক্ষকের সংসারে সুখেই আছেন।  

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও মজিবর জীবিকার দৌড়ে ছিলেন সচল। তিনি বছরের অধিকাংশ সময় বাঁশের ব্যবসা করতেন। আবার কখনো গ্রামের লোকজনের বাড়িতে করতেন দিনমজুরের কাজ। সেই আয়েই কোনোমতে চলত মজিবর রহমানের সংসার। একটি জীবনের মতোই মজিবরের স্বপ্নগুলোও ছিল খুব ছোট্ট। তার স্বপ্নের একটি নাম ছিল রূপালি ইলিশ। বাংলার মানুষের উৎসবের প্রতীক, নদীর গর্ব, আর রুচির পরম পরিতৃপ্তি এই ইলিশ মাছের প্রতি তার ছিল চরম দুর্বলতা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বাজারে ইলিশের দাম ছিল তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। প্রতি কেজি ইলিশ ২ হাজার টাকা ছুঁইছুঁই, কখনো আরো বেশি। তাই প্রতি বছরই তার মন চায় বড় এক টুকরো ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে, কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় বাজার থেকে শূন্য হাতে অসহায়ের মতো ফিরে আসতে হতো ঘরে।

এমন বাস্তবতায় গত সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ ছিল তার জন্য এক ব্যতিক্রমী সকাল। গোয়াল থেকে গরু-ছাগল বের করে দাঁত মাজতে মাজতে হাঁটছিলেন যমুনা নদীর পাড় ধরে। দূরে নদীর ধারে কয়েকজন মৌসুমি জেলে চুপিচুপি ইলিশ বিক্রি করছে। হঠাৎ এমন দৃশ্য তার চোখে পড়ে আর নদীর মৃদু বাতাসে নাকে ভেসে আসে সদ্য ধরা ইলিশের লোভনীয় ঘ্রাণ। কাছে গিয়ে শুনলেন, একেবারে টাটকা ইলিশ কেজি মাত্র ৬০০ টাকা। মজিবরের মন কেঁপে উঠল। আপন মনে ভাবলেন, এটিই বুঝি তার জীবনের সুবর্ণ সুযোগ স্ত্রীর মুখে একটুখানি আনন্দ দেয়ার। আর নিজের জিভে ইলিশের স্বাদ আস্বাদন করার। মনে মনে ভাবলেন, অনেক নামিদামি ও বিত্তবান শ্রেণির লোকজনও তো এই নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ কিনছেন। তাই, ‘এক কেজি কিনে নিলেই বা ক্ষতি কী!’

কিন্তু সেই এক মুহূর্তের ইচ্ছাই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইলিশ হাতে নিয়ে নদীর পাড় থেকে বাড়ি ফেরার সময়ই স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে ধরা পড়েন তিনি। নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ কেনাবেচার দায়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক মাসের কারাদÐ প্রদান করেন।

তেওতা ইউনিয়নজুড়ে তখন একটিই গুঞ্জন ‘মজিবর নাকি জেল খাটছে ইলিশ কেনার দায়ে!’ কেউ সহানুভ‚তি দেখাচ্ছেন, কেউ ঠাট্টা করে বলছেন, ‘ইলিশের লোভেই এমন ফল!’ কিন্তু খুব কম মানুষই ভেবে দেখলেন, একজন দরিদ্র মানুষ কতটা ক্ষুধা আর ইচ্ছার লড়াইয়ে হেরে গেলে এভাবে প্রশাসনের হাতে ধরা পড়েন।

জেলখানার দিনগুলো ছিল মজিবরের জন্য একাকীত্ব ও অপমানের প্রহর। বারবার বলতেন যে তিনি চোর নন, শুধু কয়েকটা মাছ কিনেছিলেন কম টাকায়। কিন্তু কারাগারের দেয়াল তা শোনে না, যেমন প্রশাসনের নীতিমালাও হৃদয়ের ভাষা বোঝে না।

অবশেষে, সাজা শেষ না হতেই গত ১৮ অক্টোবর বিকালের দিকে বুকের ব্যথা অনুভব করেন মজিবর। সহ-বন্দিরা ডাকাডাকি করলে জেল কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাকে মানিকগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে থেমে যায় তার নিঃশ্বাস। মৃত্যুর সময় হয়তো তার মনে একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘একটা ইলিশের স্বাদ নিতে চাওয়াটাই কি এত বড় অপরাধ ছিল?’

পরদিন ১৯ অক্টোবর দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে জেল কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তর করে পরিবারের কাছে। সাতুরিয়া গ্রামে তখন নেমে আসে শোকের ছায়া। স্ত্রী রিতা বেগম যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। হারিয়ে ফেলেছেন কান্নার ভাষা। তিনি বলছিলেন, তার স্বামী তো শুধু কয়েক কেজি মাছ কিনেছিল! সেই দোষে তাকে কারাভোগের পর মৃত্যুর কোলে ঠাঁই নিতে হলো...!

ছেলে অন্তর ঢাকা থেকে ছুটে এসে বাবার মরদেহে চুমু খেয়ে বলে, ‘বাবা, তুমি তো সবসময় বলতে মাথা উচুঁ করে বাঁচবে, কখনো কারো কাছে মাথা নিচু করবে না। তুমি চলে যাওয়ার পর মাথা উঁচু রাখার শক্তিটাই যেন হারিয়ে ফেলছি।’

পুরো সাতুরিয়া গ্রাম যেন নির্বাক! কারো মুখে আর কোনো কথা নেই। যে ইলিশ মাছ বাংলার ঐতিহ্য আর আনন্দের প্রতীক, মজিবর রহমানের অকাল প্রয়াণে তা যেন বিষাদে পরিণত হয়েছে।

এ ঘটনা শুধু মজিবরের পরিবারের নয়, এটি যেন বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর কঠোর প্রশাসনিক বাস্তবতা মিলেমিশে গড়ে তোলে এক নিঃশব্দ করুণ কাহিনী। 

প্রশাসনের চোখে মজিবর রহমান ছিলেন একজন অপরাধী। নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ক্রয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু সমাজের চোখে তিনি ছিলেন এক নিঃস্ব শ্রমিক, যিনি নিজের জীবনের তুচ্ছ আনন্দটুকুও কিনতে চেয়েছিলেন ঘামের টাকায়। অবশেষে, সেই ‘ইলিশ’ তার জন্য হয়ে উঠল মৃত্যুর কারণ।

রিতা বেগম এখন নিঃস্ব। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি চলে গেছেন নিরুদ্দেশের পথে। ছেলের সামান্য আয় দিয়ে হয়তো কোনোভাবে চলবে, কিন্তু সেই মানুষটির শূন্যতাটা কে ভরাবে? এখন রিতা বেগম সন্ধ্যায় উঠোনের পাশে বসে শুধু তাকিয়ে থাকেন পশ্চিম আকাশে, যেদিকে সূর্য ডোবে, সেদিকেই যেন হারিয়ে গেছেন তার স্বামী। ইলিশের স্বাদ পাওয়া হলো না, কিন্তু মৃত্যুর স্বাদ পেলেন তিনি। তবু হয়তো কোথাও, অন্য এক জগতে বসে তিনি এখনো ভাবছেন, ‘রিতা, এ জীবনে ইলিশ না খাওয়াই রইল, কিন্তু তোমার মুখে হাসিটা দেখার ইচ্ছা এখনো রইল...।’ মজিবরের এই মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির নয়, এটি আমাদের সমাজের যেন বিবেকের মৃত্যু।

শেষে বলা যায়, ইলিশের স্বাদ না পাওয়া সুখের চেয়ে বড় তৃষ্ণা রেখে চলে গেছেন মজিবুর। তার গল্প হয়তো আগামী দিনে সংবাদপত্রের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে, কিন্তু তার কান্না, তার বঞ্চনা, আর মৃত্যুর নিঃশব্দ প্রশ্ন এ দেশের মানুষের বিবেকের ভেতর হয়তো অনেক দিন পর্যন্ত প্রবাহমান থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় যেতে হবে: মির্জা ফখরুল

অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় যেতে হবে: মির্জা ফখরুল

ওষুধ শিল্পে ৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা

কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড ওষুধ শিল্পে ৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা

এক মাস আগে জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়: পুলিশ

এক মাস আগে জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়: পুলিশ

একনেকে ১৩ প্রকল্প অনুমোদন, ব্যয় ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা

একনেকে ১৩ প্রকল্প অনুমোদন, ব্যয় ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App