যৌন হয়রানি বন্ধে আদালতের নির্দেশনা ঝুলছে ১৬ বছর ধরে

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১১ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
দেশে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরাসরি কোনো আইন এখনো নেই। তবে একটি নীতিমালা রয়েছে। যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে যুগান্তকারী রায় দেয় উচ্চ আদালত। প্রতিরোধ কমিটি গঠনসহ এই নীতিমালা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু গত ১৬ বছরে সে নির্দেশনার বাস্তবায়ন যে তলানিতে তা আবারো সামনে এসেছে সাংবাদিক স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে।
১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমের গ্রাফিক ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের দ্বারা স্বর্ণময়ী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অন্য নারীরাও প্রধান সম্পাদক বরাবর শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন। কিন্ত অভিযুক্ত যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে প্রধান সম্পাদক কোনো ব্যবস্থা নেননি। সহকর্মীদের ভাষ্যমতে স্বর্ণময়ী কর্মক্ষেত্রে এহেন আচরণ মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।
নারী ও মানবাধিকার নেত্রীরা বলছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তায়ন হলে স্বর্ণময়ীর মতো কাউকে জীবন দিতে হতো না।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ীও, কর্মস্থলে যৌন হয়রানি একটি অপরাধ। ২০১৮ সালে আইনটি সংশোধন করে আরো কঠোর করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য এবং নির্যাতনের শিকার কর্মীরা সরাসরি শ্রম আদালতে অভিযোগ জানাতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন ১৯০ অনুমোদন করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অনুস্বাক্ষর করেনি। এই কনভেনশনের আওতায় কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আরো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা প্রতিনিয়ত সহকর্মীদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে যা তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত করার পাশাপাশি মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে তুলছে। সহিংসতার ঘটনায় বিচার না পেয়ে তারা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে যা নারীদের নিরাপত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এত বছরেরও বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক বলে মনে করেন নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতা দাস। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, কর্মস্থলে যৌন হয়রানির প্রতিকার পাওয়ার জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্টের যে নির্দেশনা, সেই মোতাবেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে কমিটি গঠন করার নির্দেশ আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
স্বর্ণময়ীর ঘটনার বিষয়টি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটিতে কমিটি গঠন এবং উক্ত অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত ও সঠিক বিচার করা হয়েছে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা স্টিম-এর এক নারীকর্মীর প্রকাশিত বয়ানে জানা গেছে, কর্মীদের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও তিন মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে কেবল বার্তাকক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে না করেছিল, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাদের এসব বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কা করেনি।
এদিকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নারী সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্টেও বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ নীতিমালা ও কমিটি করা; অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করা; কর্মজীবীদের সুরক্ষার পাশাপাশি তাদের অভিযোগ জানাতে উৎসাহিত করা এবং আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।
এ প্রসঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান মানবাধিকারকর্মী শিরীন পারভিন হক ভোরের কাগজকে বলেন, সংস্কার কমিশন থেকে যে প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারকে দেয়া হয়েছে সেখানে আমরা যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে সেটিকে আইনে রূপান্তরিত করার সুপারিশ করেছি। তবে আমি বলবো, আইন করার পাশাপাশি এ বিষয়ে অনেক বেশি প্রচার দরকার। ভুক্তভোগী অনেক নারীই জানেন না যে, হাইকোর্টের ওই নির্দেশনার ওপর ভর করে তিনি মামলা করতে পারেন। প্রতিকার পেতে পারেন। তাই এই বিষয়ে আরো বেশি প্রচার দরকার।
পরিসংখ্যান কী বলছে : মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ২২৪ জন। আর চলতি বছরের ৯ মাসে যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১৫৭ জন।
২০২০ সালে মহিলা পরিষদ এবং ‘অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশ’ পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ নারী কর্মী শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ৪৩ শতাংশ নারীর কর্মস্থলে যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে। মহিলা পরিষদ, নারী উন্নয়ন ফোরাম এবং অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশ-এর করা জরিপ বলছে, প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী তাদের সহকর্মী বা সুপারভাইজারের কাছ থেকে অশ্লীল মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণের শিকার হয়েছেন। আর বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি এবং অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশের এক জরিপে প্রায় ৪০ শতাংশ নারী কর্মী জানিয়েছেন, তাদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানালে কর্তৃপক্ষ সঠিক পদক্ষেপ নেয় না বা বিষয়টি উপেক্ষা করে। এদিকে মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির মামলার মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচার হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীরা হয়রানির শিকার হন বা তাদের মামলা দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ-এর এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পর মাত্র ১৮ শতাংশ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, এবং এর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।
স্বর্ণময়ীর মৃত্যুতে ক্ষোভ ও দোষীদের শাস্তির দাবি : স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী পক্ষ, আমরাই পারি জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানানোর পাশাপাশি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার এবং এর সঙ্গে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি সক্রিয় করার জোর দাবি জানানো হয়। এদিকে স্বর্ণময়ীর মৃত্যুকে ঘিরে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তদন্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক দায় নিরূপণের দাবি জানিয়েছেন ৫ জন বিশিষ্ট নারী। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, গবেষক ও অধিকারকর্মী সায়দিয়া গুলরুখ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা। ঢাকা স্টিমের সম্পাদক গোলাম ইফতেখার মাহমুদের কাছে পাঠানো খোলা চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছেন, অভিযোগের পর যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল কিনা। তারা ওই চিঠিতে উল্লেখ করেন, স্বর্ণময়ীসহ ২৬ জন কর্মী প্রতিষ্ঠানটির বাংলা বিভাগের প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন বলে জানা গেছে। চিঠিতে প্রশ্ন তোলা হয়েছেÑ তদন্ত কমিটি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গঠন করা হয়েছিল কিনা, বহিঃস্থ সদস্য ছিলেন কিনা এবং কেন অভিযোগকে ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হলো। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত বিবৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা চলছে।
১৯ অক্টোবর ঢাকা স্ট্রিমের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্বর্ণময়ী বিশ্বাস ঢাকা স্ট্রিমের গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন। কর্মপরিবেশে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক; সহকর্মী হিসেবে ছিলেন বন্ধুভাবাপন্ন। দক্ষতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে গত ১৩ জুলাই মানবসম্পদ বিভাগে ‘লজিং কমপ্লেইন্ট এগেইন্সট ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট বিহেভিয়ার ইন দ্য ওয়ার্কপ্লেস’ শিরোনামে একটি অভিযোগপত্র জমা পড়ে। অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং অভিযোগ তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সহকর্মীদের সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের কিছু ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের একটি আচরণবিধি চ‚ড়ান্ত করে। কর্তৃপক্ষের এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অভিযোগকারীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনমাস আগের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।