রাজস্বকর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’: সারাদেশে অচল ব্যবসা-বাণিজ্য

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ১২:০৬ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই ধুঁকছে মন্দা ও স্থবিরতার মধ্যে। বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই—ব্যবসায়ী মহলে আস্থা ও আশাবাদ হারাতে বসেছে। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ আন্দোলন কার্যত সারাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্থবির করে ফেলেছে।
শনিবার থেকে শুরু হওয়া এ শাটডাউনের প্রভাবে দেশের বন্দরে কার্যত থেমে গেছে আমদানি ও রপ্তানি। খালাস হয়নি আমদানি পণ্য, রপ্তানিমুখী পণ্য উঠানো যায়নি জাহাজে। কাস্টমস, ভ্যাট, ও আয়কর অফিসে নেই কোনো কার্যক্রম। জমা হচ্ছে না আয়কর রিটার্ন কিংবা ভ্যাট।
ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরবরাহব্যবস্থায় টান পড়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ক্ষতির অঙ্ক বাড়তেই থাকবে। ব্যবসায়ীদের দাবি—আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সংকটের সমাধান জরুরি।
আরো পড়ুন : অবরুদ্ধ এনবিআর: শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত
আন্দোলনরত কর্মকর্তারা এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের অপসারণ দাবি করছেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তাঁরা ‘কর্মবিরতি’ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন। শনিবার ও রোববারের কর্মসূচিতে সারাদেশের সকল কাস্টমস হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট এবং কর অফিস অচল হয়ে পড়ে। এতে কোনো অফিসেই কাজকর্ম হয়নি। গ্রাহকরা সেবা নিতে পারেননি। সেবা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, এক দিনেই তাঁদের অন্তত দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই শাটডাউনের আওতামুক্ত।
চট্টগ্রাম, বেনাপোল, হিলি—সবখানেই অচল বন্দর কার্যক্রম
চট্টগ্রাম বন্দর খোলা থাকলেও কাস্টমস কার্যক্রম না থাকায় পণ্য খালাস হয়নি। বেনাপোল ও হিলি স্থলবন্দরেও আমদানি-রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ। শত শত ট্রাক আটকা পড়েছে, যেগুলোর অধিকাংশ গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামালবাহী।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই শাটডাউন অর্থনীতির শ্বাসরোধ করছে। এনবিআর কাজ না করলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, উৎপাদন বন্ধ হবে, এমনকি সরকারও চলতে পারবে না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, এই অচলাবস্থা এমন এক সময়ে এলো, যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এখনই সমাধান না করলে সুশাসন ও অর্থনৈতিক উত্তরণের চেষ্টাগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এই অচলাবস্থা সরকারের গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে।
রাজস্ব আদায়ের দুঃসংবাদ
২০২৪–২৫ অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু মে পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা—লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা কম। জুন মাসে একা আদায় করতে হবে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রায় অসম্ভব। অথচ আন্দোলনের কারণে জুনের শুরুতেই রাজস্ব আদায় কার্যত শূন্যে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে রাজস্ব ভবনে নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোর।রাজস্ব ভবনের সামনেই পুলিশের জলকামান। ভেতরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব, কোস্ট গার্ড ও বিজিবির উপস্থিতি। অস্ত্র, লাঠি এবং আত্মরক্ষার ব্যাপক প্রস্তুতি। ভবনের ভেতরে ঢুকতে বাধা, ভেতরে থাকলে বাইরে যেতেও বাধা। যেন যুদ্ধের পুরোদস্তুর প্রস্তুতি। সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে এসেও নিজের অফিসে প্রবেশ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন এনবিআর ভবনে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, তাঁদের অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তারা ভবনের ভেতর অবস্থানরত চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দিয়েছে। “সচেতন নাগরিক সমাজ”-এর ব্যানারে ভবনে পোস্টার লাগিয়ে চেয়ারম্যানের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিও জানানো হয়েছে।