×

অর্থনীতি

দীর্ঘ হচ্ছে খেলাপির তালিকা

Icon

মরিয়ম সেঁজুতি

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০০ পিএম

দীর্ঘ হচ্ছে খেলাপির তালিকা

ছবি : সংগৃহীত

একদিকে কমছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে প্রান্তিক ঘুরতেই ২০ শতাংশের বেশি করে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রতি পাঁচজন ঋণগ্রহীতার একজন খেলাপি। শঙ্কা জাগানো এমন পরিসংখ্যান সামনে এনে খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো ছাড় দিতে চায় না বাংলাদেশ ব্যাংক।

এক্ষেত্রে খেলাপিদের সঙ্গে অদূরদর্শী ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। তাদের মতে, এটি শুধু পরিসংখ্যানগত সংকট নয়; বরং দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির ফল। আর শুধু কর্ম পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ না থেকে তা আদায় করে সঠিক বিনিয়োগে মনোযোগ বাড়ানোর দাবি ব্যবসায়ীদের।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভারতে ঋণখেলাপির হার ২ শতাংশেরও কম। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় ৩ শতাংশের নিচে। এমনকি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশেও খেলাপির হার ৭ শতাংশের কম। সে তুলনায় বাংলাদেশের ১৯ শতাংশ খেলাপির হার ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা প্রমাণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুন পর্যন্ত দেশে ঋণগ্রহীতা ৭৬ লাখ ৫ হাজার। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৯ হাজার ঋণগ্রহীতা অর্থাৎ প্রায় ১৯ শতাংশ গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপির তালিকায় রয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেক প্রকৃত ব্যবসায়ীও সময়মতো ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন। একই সঙ্গে ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যর্থতা, পুনঃতফসিল করা ঋণের কিস্তি পরিশোধে বিলম্ব এবং পুরনো ঋণে সুদের বোঝা বাড়তে থাকায় সংকট আরো ঘনীভ‚ত হচ্ছে।

এদিকে, অনেক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা, যারা প্রকৃত অর্থে ব্যবসায়িক ব্যর্থতা বা বাহ্যিক কারণে ঋণ শোধে অক্ষম হয়েছেন, তাদের ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে প্রকৃত ইচ্ছাকৃত খেলাপি- যারা পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করছেন না বা ভিন্ন খাতে অর্থ সরিয়ে নিয়েছেন- তাদের অনেকে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। ফলে নিরপরাধ খেলাপিরা অপরাধী হয়ে যাচ্ছেন, আর প্রকৃত অপরাধীরা দায়মুক্তি পাচ্ছেন। তাই ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা বাতিল করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা তিন হাজার ৪৮৩। তাদের কাছে আটকে আছে ২৮ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালের ১৬ এপ্রিল সব ব্যাংককে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরি করে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা, খেলাপিদের নতুন ঋণ বা সুবিধা বন্ধ করা এবং প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যাংকগুলোর নিজস্ব স্বার্থ এবং তথ্য যাচাইয়ের দুর্বলতার কারণে প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়নি, বরং নতুন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বচ্ছ তালিকা, কিন্তু ব্যাংকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছে। এতে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। তাই প্রক্রিয়াটি স্থগিত বা বাতিলের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শনে উঠে এসেছে তথ্য গোপন ও খামখেয়ালির এসব চিত্র।

সূত্র বলছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কঠোর মুদ্রানীতির কবলে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি না মিললেও বেড়ে গেছে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সুদের হার। এতে কমছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাইয়ে যেখানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ; এক বছর পর নেমেছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশে। তা আরো কমে আগস্ট শেষে হয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমন ঋণ ধারায় বিনিয়োগের খরায় ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সিনিয়র সভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী বলেন, আমরা স্থানীয়রা আস্থা পাচ্ছি না, বিদেশিরাও আস্থা পাচ্ছে না। এজন্য একটি স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন। স্থিতিশীল ব্যাংকিং নীতি প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি এমন, অনেক ব্যাংক বর্তমানে ঋণ দিচ্ছে না। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে বসে আছে, নিরাপদ রিটার্ন নিশ্চিত হওয়ার কারণে। তারা জানে ১২ শতাংশ রিটার্ন পাবেন, তাই তারা শিল্প খাতের দিকে বিনিয়োগ করছে না। 

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমার বিপরীতে প্রতি তিন মাসে ২০ শতাংশের বেশি করে বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ, যা গত জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা ছাড়িয়ে যেতে পারে ৬ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তিন মাস আগেও মার্চে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি এবং ২০২৪ সাল শেষে ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশই এখন ঝুঁকিপূর্ণ বা চাপের মধ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঋণ পুনঃতফসিলের নিয়ম পরিবর্তনের কারণেও খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণখেলাপি ঘোষণার সময়সীমা ২৭০ দিন থেকে কমিয়ে ১৮০ দিন করা হয়, আর ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে তা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৯০ দিনে নামানো হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ মাঠপর্যায়ের অডিটের পর বেশ কিছু বড় ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, উচ্চ সুদহার এবং ঋণ পুনঃতফসিলে গঠিত কমিটির কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে খেলাপি গ্রহীতা বেড়েছে। এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের কিছু নির্দেশনা স্পষ্ট করতে আমরা সম্প্রতি গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার স্পষ্ট করলে অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপির তকমামুক্ত হতে পারবেন।

এদিকে, খেলাপির ভারে নুইয়ে পড়া দেশের ব্যাংক খাতকে টেনে তুলতে ঋণের বিপরীতে থাকা সম্পত্তি স্ব-স্ব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিতে কঠোর হতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, সুদের হার প্রতিনিয়ত প্রযোজ্য হচ্ছে। তাই আগামী তিন মাসে যদি কোনো খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করে, শুধু সুদ আরোপের কারণে তাদের ঋণের পরিমাণ আরো ২০ শতাংশ বেড়ে যাবে। তাদের ক্ষেত্রে যত প্রকার আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব, তা নিতে হবে। 

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কার্যত ভেঙে পড়েছিল। এখন তা পুনর্গঠন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, বিপুলসংখ্যক খেলাপি ঋণগ্রহীতা আমাদের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিনের দুর্বল পরিশোধ সংস্কৃতি ও শিথিল তদারকির প্রতিফলন। ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাদের মধ্যে এক ‘অশুভ আঁতাত’ তৈরি হয়েছিল। এর ফলে ব্যাংক খাতে এক ধরনের দায়মুক্তির বিষাক্ত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। 

জানা গেছে, এই বিপুল খেলাপি ঋণের বোঝা মোকাবেলায় সরকার এখন বাজেট থেকে করদাতাদের অর্থ ব্যবহার করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে মার্জ করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অনিয়ম, অর্থপাচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো ব্যাংক খাতকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর বিচার বা জবাবদিহি হয়নি। এ পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও গভীর হতাশাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জনগণের টাকায় ব্যাংক রক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও প্রকৃত দায়ীদের আইনের আওতায় না আনা হলে খাতের আস্থাহীনতা আরো গভীর হবে।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

মেট্রোরেলে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ

মেট্রোরেলে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ

ব্যক্তিপর্যায়ে সিম নিবন্ধন কমিয়ে আনা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ব্যক্তিপর্যায়ে সিম নিবন্ধন কমিয়ে আনা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ডিজিটাল মিডিয়া এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন পাবনার পলাশ হোসেন

ডিজিটাল মিডিয়া এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন পাবনার পলাশ হোসেন

দীর্ঘ হচ্ছে খেলাপির তালিকা

দীর্ঘ হচ্ছে খেলাপির তালিকা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App