মিথ্যা মামলা ও গ্রেপ্তার কমাতে বিধান করছে সরকার: আইন উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ০৭:৪৪ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, দেশে মিথ্যা মামলা ও অযৌক্তিক গ্রেফতার কমাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান আনতে চলেছে সরকার। আমরা কিছু বিধান আনছি। এখনই সব খুলে বলছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, মিথ্যা মামলা ও অযাচিত গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। অন্তত কিছুটা হলেও এটি কমবে বলে আশা করছি।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ‘অ্যাক্সেসিবল অ্যান্ড ইফেক্টিভ ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমস’ শীর্ষক এক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিআইআইএসএস-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস এতে সভাপতিত্ব করেন। সংলাপে ইউএনওডিসি’র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের উপ-প্রতিনিধি ড. সুরুচি প্যান্ট স্বাগত বক্তব্য দেন এবং বাংলাদেশ অফিসের প্রধান ফেলিপে রামোস সংলাপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন।
আসিফ নজরুল বলেন, আমরা যাই করি না কেন, কিছু লোক বলে আমরা পুলিশকে আরও ক্ষমতা দিন। আর যদি আমরা না করি, তাহলে লোকে বলে, আমরা কিছুই করছি না। তাই আমরা ঝুঁকি নিচ্ছি। মিথ্যা মামলা ও অযৌক্তিক গ্রেফতার কমাতে আমরা কিছু বিধান আনছি।
বিচার বিভাগ নিয়ে সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রথমবারের মতো ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। গুমের ওপর একটি নতুন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় আছি। একে গুম সংক্রান্ত কনভেনশনের সঙ্গে যতটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করছি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, বিচার বিভাগের মামলার চাপ কমাতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। আগে যেখানে প্রতি জেলায় একজন লিগ্যাল এইড অফিসার থাকতেন, এখন সেখানে তিনজন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সরকার ছোটখাট মামলা যেমন- পারিবারিক বিরোধ, পাঁচ লাখ টাকার নিচের চেক সংক্রান্ত মামলা কিংবা পিতা-মাতার ভরণপোষণ সংক্রান্ত মামলায় প্রথমে মধ্যস্থতাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সময় ও খরচ উভয়ই কমবে।
আসিফ নজরুল বলেন, সরকার ইতোমধ্যে মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে, যা প্রায় ৩ লাখ মানুষের জীবনকে বিপদে ফেলেছে। আগামী ছয় মাসে ২০ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা বাড়াতে বিচারকদের সম্পদ ঘোষণাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আদালত কর্মী নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় নিয়োগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
ইউএনওডিসি ও বিআইআইএসএস-এর মতো অংশীদারদের সংলাপ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমি আত্মবিশ্বাসী যে বাংলাদেশ একটি দ্রুত, ন্যায্য, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে।
অনুষ্ঠানে বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের নানা দিক তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে আইনি সহায়তা, রাষ্ট্রপক্ষের কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক মান ও প্রমাণভিত্তিক ভালো চর্চা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়। বিচার সংস্কার কমিশন যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে, সেগুলোকেই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য করা হয়।
সংলাপে মোট তিনটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম গোলটেবিলের বিষয় ছিল, ‘আসামি, আটক, গ্রেফতার বা কারাবন্দি ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ও সাক্ষীদের জন্য আইনি সহায়তা আরও সহজে কীভাবে পাওয়া যায়, তা শক্তিশালী করা।’ এই পর্বটি পরিচালনা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিম হুসাইন শাওন।
ইউএনওডিসি’র ভিয়েনা সদর দপ্তরের ‘অ্যাকসেস টু জাস্টিস’ টিমের প্রধান আনা জিউডাইস বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেন। ইউএনডিপি’র বিচার বিভাগে ডিজিটালাইজেশন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার ডেকার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরাসরি আলোচনায় অংশ নেন। অপর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইউএনওডিসি’র প্রাক্তন পরামর্শক নিকোলাস লাইনো ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন। এছাড়া ব্লাস্ট-এর নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন জাতীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।
দ্বিতীয় গোলটেবিল আলোচনা ছিল- নিরপেক্ষ, পেশাদার ও জবাবদিহিমূলক প্রসিকিউশন সার্ভিস প্রতিষ্ঠা। এতে উপস্থিত ছিলেন ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। তৃতীয় গোলটেবিলের বিষয় ছিল- অধিক কার্যকর ও মানবাধিকারভিত্তিক তদন্তের জন্য পুলিশ-প্রসিকিউশনের সহযোগিতা শক্তিশালী করা। এতে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পুলিশ, ইউএনওডিসি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। প্রতিটি গোলটেবিলের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিচার সংস্কার কমিশন, বার কাউন্সিল, পুলিশ, এনজিও ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।