পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়ভার সামলাতে নাকাল রোগীরা

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৫:৫৫ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসায় রোগীর ‘আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার’ বা নিজস্ব ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১২ সালে। ওই বছর স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। সেখানে ২০৩২ সালের মধ্যে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ এক যুগেও এ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। ব্যক্তির ব্যয় কমেনি, বরং ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
দেশের সবশেষ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন রোগীকে মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ বহন করতে হয়। চিকিৎসার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধ কিনতে। এতে ব্যয় ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া রোগ শনাক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০২৪ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণার তথ্যানুসারে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়, যা মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। কেননা, কম সরকারি বরাদ্দ এবং যা বরাদ্দ হয় সেটিরও কার্যকর ব্যয় না হওয়ায় মানুষের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে বছরে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ অর্থ। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে ওষুধ কিনতে গিয়ে ৫৪ দশমিক ৪০ শতাংশ; দ্বিতীয় অবস্থানে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সাশ্রয়ী, মানসম্মত ও সহজলভ্য করতে বেসরকারি হাসপাতালে সেবামূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা, স্বাস্থ্যসেবার ফি ও রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য আলাদাভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। এই মূল্য বা ফি’র তালিকা দৃশ্যমান জায়গায় প্রদর্শন করতে হবে। এসব বিধান না মানলে ব্যবস্থা নিতে পারবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ ব্যাপারে সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন বলেছিলেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ফি নমুনা (রোগ নির্ণয়ে) পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে এই সুপারিশ করা হয়েছে। অনেক হাসপাতাল ইচ্ছামতো ফি নির্ধারণ করে। এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রোগীর সুরক্ষা, অর্থ বরাদ্দ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। এই আইনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বেসরকারি হাসপাতালের সেবা মূল্যে বেঁধে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এই মূল্য দুই বছর পর পর হালনাগাদ করার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৭০ শতাংশই বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে চিকিৎসাসেবা সবকিছুই অনিয়ন্ত্রিত। এই সংকট নিরসনে ২০১৯ সাল থেকে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবামূল্য নির্ধারণের বিষয়টি আলোচনায় শুরু হয়। চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সেবামূল্য নির্ধারণে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে ১৩৯টি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার তালিকা দেয়া হলেও ৪৪টি পরীক্ষার বিষয়ে কোনো মূল্য প্রস্তাব করা হয়নি। এছাড়া ৮টি বিশেষায়িত পরীক্ষা এবং ২১টি অস্ত্রোপচারের মূল্যও রাখা হয় প্রস্তাবের বাইরে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব পরীক্ষা ও সেবামূল্যের প্রস্তাব করা হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলোর কিছুই হয়নি। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এ জরিপের তথ্য বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ কম হওয়ায় চিকিৎসায় মানুষের ব্যক্তিগত খরচ বাড়ছে। তাই নিজস্ব খরচে চিকিৎসার ব্যয়ভার কমাতে ৯২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ চান, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দের ভাগ বাড়ুক।
এ প্রসঙ্গে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর নীতিমালা না থাকায় বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সেবামূল্য অসংগতিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের কথাতেও উঠে এসেছে রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রসঙ্গটি। রোগীদের অপ্রয়োজনীয় ও অযথা স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে অতিরিক্ত অর্থলাভের প্রবণতা বন্ধ করতে চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা বলেন, দেশে ডাক্তাররা রোগী দেখা মাত্রই নানা টেস্ট দিয়ে দেন। আমার বাসার এক হেল্পিং হ্যান্ড সম্প্রতি চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিল। তাকে ১৪টি পরীক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু কোনো টেস্ট ছাড়াই গ্রামে গিয়ে পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শে সে সুস্থ হয়ে গেছে। এ ধরনের অত্যাচার বন্ধ করুন। গরিব রোগীদের গলা কাটা বন্ধ করুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো হাসপাতালে কত টেস্ট হয় তার কোনো মনিটরিং নেই। আমরা কিন্তু জানি না একজন ডাক্তার বছরে কোন অসুখের জন্য কত টেস্ট দিয়েছে। এটি যদি অনলাইনে মনিটর করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে বেশি করে ডায়াগনস্টিক টেস্ট হচ্ছে কিনা। এটা করা যাচ্ছে না বলে আমরা বলতে পারছি না, সব টেস্টে রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় কিনা।
মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হলে হেলথ স্ট্যাটাস বেড়ে যাবে। ব্যক্তির পকেট ব্যয় বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২১ সাল থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়া শুরু হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দামও কয়েক দফা বেড়েছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত অন্যান্য জিনিসের দামও বেড়ে যাবে।