ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে বেশি কারা? লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:১৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বর সাধারণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষাকালে দেখা দেয়। এটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এ মশা সাধারণত উষ্ণ, আর্দ্র পরিবেশে এবং জমে থাকা পানিতে বংশবিস্তার করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। ডেঙ্গুর বিস্তার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিই এই রোগের কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়া কমাতে সহায়ক হতে পারে।
ডেঙ্গুর কারণ ও যেভাবে ছড়ায়
বাংলাদেশ কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন (DENV 1–4) এডিস ইজিপ্টি মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশাগুলো সাধারণত সকালে ও বিকেলের শেষ দিকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে এবং পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে বংশবিস্তার করে। ভাইরাসটি সরাসরি একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়ায় না। তবে এক আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিতে মশা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
বংশবিস্তারের স্থান
ফুলের পাত্র ও ট্রে
খোলা পানির পাত্র
ছাদে জমে থাকা পানি
ব্যবহৃত টায়ার ও প্লাস্টিক পণ্য
নির্মাণাধীন এলাকা যেখানে পানি জমে থাকে
ঢাকার মতো শহুরে এলাকায় দুর্বল নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং ঘনবসতি বৃষ্টির সময় এই ভাইরাসজনিত রোগের দ্রুত বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ঝুঁকিতে যারা
যে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি জটিল ও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। Dengue.com তথ্য অনুযায়ী, এদের মধ্যে রয়েছে-
১২ বছরের কম বয়সী শিশু
বৃদ্ধ লোকজন
গর্ভবতী নারী
ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগী
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
যদিও আগে গ্রামীণ অঞ্চল তুলনামূলক ডেঙ্গু আক্রান্ত কম হতো। সাম্প্রতিক তথ্য থেকে দেখা যায়, এখন গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহীসহ অনেক জায়গায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটি রোগটির ভৌগোলিক বিস্তারে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
লক্ষণ
মায়ো ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী, এডিস মশার কামড়ের ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা যায়। এই রোগ হঠাৎ শুরু হয় ফ্লু’র মতো লক্ষণ দিয়ে এবং যদি সময়মতো খেয়াল রাখা না হয়; তাহলে দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।
উপসর্গ
উচ্চ মাত্রার জ্বর (সাধারণত 39°C বা 103°F এর ওপরে)
মাথা ও চোখের পেছনে তীব্র ব্যথা
পেশী, হাড় ও জয়েন্টে ব্যথা
বমি বমি ভাব ও বমি
খাবারের প্রতি অনীহা
মাড়ি বা নাক থেকে সামান্য রক্তপাত
ত্বকে র্যাশ, যা জ্বরের ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে দেখা দেয়
কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো আরও গুরুতর হয়ে জীবনহানির ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এই গুরুতর রূপকে বলা হয় সিভিয়ার ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। এতে শরীরের অভ্যন্তরীণ ব্লিডিং, শরীরে অতিরিক্ত তরল জমা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর লক্ষণসমূহ হলো-
তীব্র পেট ব্যথা
বারবার বমি হওয়া
ত্বক বা মিউকাস মেমব্রেন থেকে রক্তপাত
শ্বাসকষ্ট
ঠাণ্ডা ও ভেজা ত্বক
রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া
এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
প্রতিরোধ
ডেঙ্গু প্রতিরোধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমানে বাংলাদেশে এই মশাবাহিত জ্বরের জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা বা গ্রহণযোগ্য ভ্যাকসিন নেই। তাই ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে সবাইকে মিলে মশার বংশবিস্তার প্রতিহত করা এবং সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য কাজ করতে হবে।
মশার সবচেয়ে সক্রিয় সময়- সকাল ও সন্ধ্যায় লম্বা হাতা শার্ট ও প্যান্ট পরিধান করা
DEET বা পিকারিডিন যুক্ত মশা প্রতিরোধক ক্রীম ব্যবহার করা
দিনেও মশারি ব্যবহার করা, কারণ এডিস মশা দিনেও সক্রিয় থাকে
জানালা ও দরজায় নেট বসানো
ভোর ও সন্ধ্যার সময় অপ্রয়োজনীয় কাজে বাইরের যাওয়া এড়িয়ে চলা
এছাড়া পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যেমন-
নিয়মিত পানি সংরক্ষণের পাত্রগুলো পরিষ্কার করা এবং জমে থাকা পানি ফেলে দেয়া
পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ঢেকে রাখা
গাছের ট্রে এবং ছাদের ট্যাঙ্কে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলা
নিজ বাসা এবং আবাসিক এলাকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা
ডেঙ্গু রোগের সঠিক নির্ণয়ের জন্য রোগীর উপসর্গসমূহ এবং ল্যাব টেস্ট দুটোই প্রয়োজন হয়। সারাদেশে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক সময়মতো ভাইরাসজনিত জ্বর শনাক্ত ও চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন টেস্ট এবং প্যাকেজ প্রদান করে। ঢাকার যেকোনো জায়গায় ডেঙ্গু টেস্ট সুবিধা নিতে পারেন। সাধারণত ব্যবহৃত টেস্টগুলোর মধ্যে রয়েছে-
NS1 অ্যান্টিজেন টেস্ট
IgM এবং IgG অ্যান্টিবডি টেস্ট
প্লেটলেট ও সাদা রক্তকণিকা মাত্রা পর্যবেক্ষণের জন্য কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC)
ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই এবং চিকিৎসা মূলত উপসর্গ নির্ভর। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বিশ্রাম নেয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। তবে অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ওষুধ এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু চিকিৎসায় শরীরে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ বা হাইড্রেশন বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবে বিটরুট বা ডালিমের রসের মতো লাল রঙের তরল খাবার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন তারা। কারণ রোগী বমি করলে এগুলোর রং রক্তের সঙ্গে মিলে গিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। ফলে প্রকৃত রক্তপাত শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, যেন সঠিক চিকিৎসা ও ডোজ নির্ধারণ করা যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো চিকিৎসা নেয়া বা মেডিসিন গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে বা যাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন, আইভি ফ্লুইড/ স্যালাইন বা অন্যান্য চিকিৎসা নিতে হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
বেশিরভাগ পর্যাপ্ত বিশ্রামের মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ যদি নিচের যেকোনো লক্ষণ অনুভব করেন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন-
তিন দিনের বেশি সময় ধরে উচ্চ মাত্রার জ্বর
তীব্র পেটব্যথা
একটানা বমি ও পানিশূন্যতার লক্ষণ
নাক বা মাড়ি থেকে রক্তপাত
বমিতে বা মলে রক্ত
বিভ্রান্তি, ঘুম ঘুম ভাব, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা
প্রাথমিক ডায়াগনোসিস ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে সহায়তা করে। ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ বা প্রশ্ন থাকলে এখনই কনসালটেশন বুক করুন স্বাস্থ্য পরামর্শ ও ওষুধের জন্য।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর
১. বাংলাদেশে কি ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন রয়েছে?
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর জন্য জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী কোনো ভ্যাকসিন নেই। প্রতিরোধ ও সচেতনতাই এখন সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা।
২. ডেঙ্গু কি একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়?
না, ডেঙ্গু রোগ একজন মানুষ থেকে আরেকজনের মধ্যে সরাসরি ছড়ায় না। এটি ছড়ায় তখনই, যখন কোনো ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত এডিস মশা কাউকে কামড়ায়।
৩. ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠতে সাধারণত কত সময় লাগে?
সাধারণভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। তবে কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও শারীরিক ক্লান্তি আরও কিছুদিন স্থায়ী হতে পারে।
৪. কীভাবে ডেঙ্গু এবং সাধারণ ফ্লু-এর পার্থক্য বুঝবো?
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণত উচ্চ মাত্রার জ্বর হয়। সঙ্গে থাকে জয়েন্ট ও পেশিতে ব্যথা, ত্বকে র্যাশ এবং কিছু ক্ষেত্রে রক্তপাতও হতে পারে। এসব উপসর্গ সাধারণ ফ্লু-তে সাধারণত দেখা যায় না।
৫. ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের কি হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার?
সাধারণ উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় থেকেই চিকিৎসা দেয়া যায়। তবে সতর্কতামূলক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন।
ডিসক্লেইমার (সতর্কীকরণ)
এই আর্টিকেলে দেয়া তথ্য শুধু সাধারণ জ্ঞানের জন্য। এটি পেশাদার চিকিৎসা পরামর্শ, রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার বিকল্প নয়। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে সঠিক পরামর্শের জন্য অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।