×

স্বাস্থ্য

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ

অ্যান্টিবায়োটিকের লাগামহীন ব্যবহার ডেকে আনছে বিপর্যয়

Icon

সেবিকা দেবনাথ

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১৭ পিএম

অ্যান্টিবায়োটিকের লাগামহীন ব্যবহার ডেকে আনছে বিপর্যয়

ছবি : সংগৃহীত

অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ডেকে আনছে মহাবিপর্যয়। ইতোমধ্যেই তা বাংলাদেশের জন্য বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডাব্লিউএইচও) বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) দ্রুত বাড়ছে।

চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ডাব্লিউএইচওর ‘গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সার্ভিলেন্স রিপোর্ট-২০২৫’ এ বলা হয়েছে, মারাত্মক সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ইমিপেনেম। যার বিরুদ্ধে ‘অ্যাসিনেটোব্যাকটার এসপিপি’ নামক ব্যাকটেরিয়ার ৯৭ শতাংশ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া রক্তপ্রবাহ ও মূত্রনালির সংক্রমণের জন্য দায়ী ‘ই. কোলাই’ ও ‘ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া’ ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে থার্ড জেনারেশন সেফালোস্পোরিন ও ফ্লুরোকুইনলোনসের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবেদনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্স হারের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর এক গবেষণায়ও  অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ভর্তি হওয়া নবজাতকদের ৮১ শতাংশই কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী ক্লেবসিয়েলা নিউমোনি নামক ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হচ্ছে- যা ডাব্লিউএইচওর তালিকায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি রোগজীবাণু। সংক্রমিত এসব নবজাতকের ৭০ শতাংশই হাসপাতালে ভর্তির ৪৮ ঘণ্টা পর জীবাণুর সংস্পর্শে এসেছে- যা হাসপাতাল থেকে ছড়ানো সংক্রমণের উচ্চ হারকে নির্দেশ করে। শুধু নবজাতকই নয়, প্রাপ্ত বয়স্কদের আইসিইউতে থাকা ৬০ শতাংশ রোগীর শরীরেও কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরেলস (সিআরই) পাওয়া গেছে। গবেষণায় মা ও শিশুর ওপর পর্যবেক্ষণেও উদ্বেগজনক তথ্য মিলেছে। প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু জন্মের প্রথম বছরের মধ্যে সিআরই এবং প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু এক্সটেন্ডেড-স্পেকট্রাম সেফালোস্পোরিন-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরেলস (ইএসসিআরই) দ্বারা সংক্রমিত হয়। এক বছর বয়স হওয়ার আগেই এসব শিশুর ৮০ শতাংশেরও বেশি অন্তত একবার অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেছে- যা তাদের শরীরের মাইক্রোবায়োমের ক্ষতির পাশাপাশি প্রতিরোধী জীবাণুর বিকাশ ঘটাচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে রোগীদের প্রায় ৬৫ শতাংশই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে। দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ৪০ হাজার রোগী এএমআর সংক্রমণের কারণে মারা যাচ্ছেন। তুলনামূলকভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এটি প্রতি বছর ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, যদি এএমআর নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে।

ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিড ফর গেøাবাল সলিউশন’ শীর্ষক একটি বিশ্লেষণধর্মী বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বিশ্বের ২৬ জন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও ওষুধ বিশেষজ্ঞ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে হারে বাড়ছে, তাতে হয়তো দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে মানুষ সংক্রামক রোগে অসহায় মৃত্যুবরণ করবে। রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা আগামী ৫ বছরে জ্যামিতিক হারে বাড়বে।

এএমআর সমস্যা শুধু দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নয়, অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। গবেষণা অনুযায়ী, এএমআরর কারণে চিকিৎসা ব্যয় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীরা এক বছরেই প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বেশি খরচ করছেন, যেখানে সাধারণ সংক্রমণে এই ব্যয় কম হওয়া উচিত ছিল।

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকারিতা হারানোর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অবাধ বিক্রি, অপ্রয়োজনীয় ও ভুল প্রয়োগ, ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ না করা এবং খামারে যথেচ্ছ ব্যবহার। ‘ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট,-২০২৩’ অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ এবং এর ব্যত্যয়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ তা জানা নেই অনেক ফার্মেসি বিক্রেতারই। ২০২২ সালে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ ফার্মেসি বিক্রেতাই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অবগত নন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ জানান, বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রচলিত আছে, তার বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে হারে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছে, সে হারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হচ্ছে না। যে গতিতে পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হচ্ছে, তাতে অচিরেই চিকিৎসকদের সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু সংক্রমণের ভয়ে অতি ছোট সার্জারি করতেও চিকিৎসকরা সাহস পাবেন না। বর্তমানে বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে, তা পুরনো বা প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের সংক্ষিপ্ত রাসায়নিক রূপান্তর মাত্র। এসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারছে না বা পারবে না।

নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনীহা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর পেছনে কারণও আছে। একটি অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু সে তুলনায় মুনাফা করা যায় না। কোম্পানিগুলোর মতে, মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে অল্প কয়েক দিনের জন্য। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ক্ষেত্রে যেমন রোগীকে আজীবন ওষুধ গ্রহণ করতে হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে তেমন হয় না। দ্বিতীয়ত, একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হওয়ার পর অল্প কয়েক বছরে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেলে মুনাফা তো দূর, পুঁজিও ফেরত আসে না। উদ্ভাবনের পর অ্যান্টিবায়োটিকের অনুমোদন পেতেও অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদনও পাওয়া যায় না। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে বিনিয়োগে আজকাল আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী, জয়ী হচ্ছে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এই অশনিসংকেত বারবার উচ্চারিত হলেও সবাই নির্বিকার। অথচ কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে হতে পারে করুণ পরিণতি।

পশুপালন খাতেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা গেছে। বাংলাদেশে মুরগি, গরু ও মহিষের খামারে রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। কৃষি ও পশুপালন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যাচ্ছে। এটি মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সাহায্য করছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাজার থেকে সংগৃহীত মুরগির নমুনায় ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সালমোনেলা স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। 

‘এখনই পদক্ষেপ নিন, আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করুন, আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করুন’ এই ¯েøাগান নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ। ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত এই উপলক্ষে নানা কর্মসূচিও পালিত হবে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের উদ্যোগে এবং পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ, শিশু বিভাগ, ফার্মাকোলজি বিভাগ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় র‌্যালি, সংক্ষিপ্ত সমাবেশ, ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, বিশ্বে বহু মানুষ অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মৃত্যুর মতো ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে। তাই একে এখনই মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য চিকিৎসক, রোগী ও ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রেতাদের সচেতন হতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

মোদি সরকারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ, বললেন জয়

মোদি সরকারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ, বললেন জয়

টানা ১০ম বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিলেন নীতিশ কুমার

টানা ১০ম বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিলেন নীতিশ কুমার

জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউট ও জলবায়ু রোডম্যাপের দাবি

কপ৩০-এর ৯ম দিন জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউট ও জলবায়ু রোডম্যাপের দাবি

মুশফিক-লিটনের সেঞ্চুরি ও রেকর্ড জুটিতে বাংলাদেশের ৪৭৬

মুশফিক-লিটনের সেঞ্চুরি ও রেকর্ড জুটিতে বাংলাদেশের ৪৭৬

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App