ইয়েমেনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতীয় নার্সকে ক্ষমা করবে না নিহতের পরিবার

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ০৮:৫২ এএম

নিমিশা প্রিয়া ও আব্দেলফাতাহ্ মাহদি। ছবি : সংগৃহীত
ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজাই মানা হবে না, এমন কথা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে ইয়েমেনে নিহত তালাল আব্দো মাহদির পরিবার। নিহতের ভাই আব্দেলফাতাহ মাহদি সম্প্রতি বিবিসি অ্যারাবিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট জানিয়েছেন, আল্লাহর তৈরি আইন ‘কিসাস’ কার্যকর করতে হবে, অন্য কিছু নয়।
২০১৭ সালে ইয়েমেনে ব্যবসায়িক অংশীদার তালাল মাহদিকে হত্যার দায়ে নিমিশা প্রিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ইয়েমেনের আদালত। বুধবার সেই সাজা কার্যকরের কথা থাকলেও তা আপাতত স্থগিত করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। তবে মাহদি পরিবার বলছে, এ সিদ্ধান্তে তারা হতাশ।
‘রক্ত নিয়ে ব্যবসা নয়’
ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিমিশার পরিবারের পক্ষে ১০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ‘ব্লাড মানি’ (রক্তমূল্য) প্রস্তাব করা হলেও তা নাকচ করেছে নিহতের পরিবার। আব্দেলফাতাহ মাহদি বলেন, আমরা কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না। রক্ত নিয়ে ব্যবসা করা যায় না। ন্যায়বিচারই চাই।
বিবিসি আরবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের পর নিজের ফেসবুক পোস্টেও নিহতের ভাই লেখেন, যতক্ষণ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হচ্ছে, ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাব। আদালত জানে, আমরা কোনো সমঝোতা চাই না।
‘ভারতীয় গণমাধ্যম সত্য বিকৃত করছে’
আব্দেলফাতাহ মাহদি ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তার দাবি, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে যে তালাল নাকি নিমিশার পাসপোর্ট আটকে রেখেছিল, শোষণ করেছিল—এ সব মিথ্যা। কোনো শুনানিতেও এসব প্রমাণ হয়নি। জনমত প্রভাবিত করতে সত্য বিকৃত করছে ভারতের কিছু গণমাধ্যম।
ভারত সরকারের প্রচেষ্টা
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ইয়েমেন সরকার ও প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, এটি খুবই সংবেদনশীল বিষয়। সরকার পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়েছে, আইনজীবী নিয়োগ করেছে, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
আরো পড়ুন : আ.লীগ নেতাদের ভারতে আশ্রয় নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য মমতার
তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়েমেনে ভারতের কূটনৈতিক প্রভাব দুর্বল হওয়ায় সমঝোতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
‘কিসাস’ কী?
ইসলামি শরিয়া আইনে ‘কিসাস’ মানে প্রতিশোধ বা সমপরিমাণ শাস্তি। সহজভাবে বলতে গেলে প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার চাইলে ক্ষমা করাও সম্ভব—কিন্তু মাহদি পরিবার সে সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে খারিজ করেছে।
বাঁচানোর লড়াই
নিমিশা প্রিয়ার মা বর্তমানে ইয়েমেনেই অবস্থান করছেন মেয়ের প্রাণ রক্ষায়। ‘সেইভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল’ নামে একটি সংগঠন ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ক্রাউডফান্ডিং করে ব্লাড মানির অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করছে। কিন্তু নিহতের পরিবার অনড়—ক্ষমা নয়, ‘কিসাস’ই চূড়ান্ত।
নিমিশা প্রিয়ার পুরো ঘটনাটি কী?
কেরালার পালাক্কর জেলার বাসিন্দা নিমিশা নার্সের চাকরি নিয়ে ২০০৮ সালে ইয়েমেনে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর স্বামী টমি থমাস এবং মেয়ের সঙ্গেই থাকছিলেন নিমিশা। পরে ২০১৪ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার স্বামী এবং ১১ বছরের মেয়ে ভারতে ফিরে এলেও নিমিশা সেখানেই থেকে যান। তার ইচ্ছা ছিল, ইয়েমেনে নিজের ক্লিনিক খুলবেন।
২০১৪ সালে ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। মাহদি তাকে নতুন ক্লিনিক খুলতে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দেন। কারণ আইন অনুযায়ী, ইয়েমেনে নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে দেশীয় অংশীদার রাখা বাধ্যতামূলক। সেই মতো ২০১৫ সালে দু’জন মিলে নতুন ক্লিনিক খোলেন; কিন্তু এর পর থেকেই শুরু হয় দুই অংশীদারের মতবিরোধ।
অভিযোগ, নিমিশার অর্থ এবং পাসপোর্ট মাহদি কেড়ে নিয়েছিলেন মাহদি। মারধর করে নিমিশাকে মাদকসেবনেও বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে মাহদির বিরুদ্ধে। আইনি কাগজপত্রে নিমিশাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়ে প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়ার পথও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মাহদিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন ওই নার্স। নিমিশার দাবি, মাহদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ওভারডোজের কারণে মৃত্যু হয় মাহদির। এর পর হানান নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে মাহদির দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেন ওই নার্স। ওই মাসেই ইয়েমেন ছেড়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে যান নিমিশা। সেই থেকে ইয়েমেনের জেলেই বন্দি রয়েছেন এই ভারতীয় নারী।
নিমিশার মা একজন দরিদ্র গৃহকর্মী। মেয়েকে রক্ষা করতে ২০২৪ সাল থেকে ইয়েমেনে আছেন তিনি।
নিহত তালাল আব্দো মাহদির পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও আলাপ-আলোচনার জন্য ইয়েমেনের একজন সমাজকর্মী স্যামুয়েল জেরোমকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন।
নিমিশা প্রিয়ার প্রাণ বাঁচানোর জন্য 'সেইভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল' নামে একটি লবি গ্রুপও গড়ে তোলা হয়েছে, ভারতে ও ভারতের বাইরে থেকে নানা দেশ থেকে তারা ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমে অর্থও সংগ্রহ করছেন।