তিস্তা প্রকল্পের জন্য প্রস্তুত চীন

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৩:৫৩ এএম

তিস্তা প্রকল্পের জন্য প্রস্তুত চীন
চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ কোনোভাবেই তৃতীয় কোনো পক্ষবিরোধী জোট নয়। এটি নিয়ে অন্য কোনো দেশের উদ্বেগেরও কিছু নেই। তবে প্রতিবেশী অন্যান্য দেশকে এমন তথ্যের কথা জানালেও তারা কীরকম সাড়া দিয়েছে তা রাষ্ট্রদূত জানাননি। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ডিক্যাব) আয়োজিত ‘ডিক্যাব টক’-এ একথা বলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই জোট গঠনের কথা অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু ঢিক্যাব টকে চীনা রাষ্ট্রদূত বিষয়টি খোলাসা করে দিলেন। এরফলে ভূরাজনীতিতে এই জোট প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাবেক ডিক্যাব সভাপতি শামিম আহমেদের মৃত্যুতে এবং সম্প্রতি উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিশু ও অন্যান্য নিরীহ মানুষের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
গতকাল ঢিক্যাব টকে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। এ উদ্যোগের কেন্দ্রে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। এটি কোনোভাবেই তৃতীয় কোনো পক্ষবিরোধী জোট নয় এবং এ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। এটি নিয়ে অন্য কোনো দেশের উদ্বেগের কিছু নেইও। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, এর লক্ষ্য উন্নত ও সমৃদ্ধ প্রতিবেশী গড়ে তোলা এবং তাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা। মার্কিন শুল্ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াও ওয়েন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ নীতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে করে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়তে পারে। তিস্তা বহুমুখী প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে তিনি বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশে ‘সুশৃঙ্খল, সফল ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন চায় চীন :
বাংলাদেশ এখন সংস্কার ও উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব অতিক্রম করছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। এ যাত্রায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি চীনের সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তাছাড়া বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও সফল জাতীয় নির্বাচন এবং দেশের প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত উন্নয়ন পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায়ও চীনের সমর্থন রয়েছে বলে আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। গতকাল ঢিক্যাব টকে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে ইয়াও ওয়েন বলেন, চীন চাইছে বাংলাদেশে একটি সুশৃঙ্খল, সফল ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কেবল বাংলাদেশের জনগণের, বাইরের কোনো দেশের নয়।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান-চীন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ:
অনুষ্ঠানে চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত ইয়াও জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি লক্ষ করেই চীন এই উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, চীনের বহু ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ রয়েছে। এ উদ্যোগটি সর্বশেষ সংযোজন মাত্র। গত কয়েক মাসে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সব রাজনৈতিক দলকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশে এখন সুযোগ রয়েছে তাই চীন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত। এর আগে বিএনপি ও জামায়াতসহ কিছু দলের সঙ্গে এ ধরনের যোগাযোগে বাধা ছিল।
এ নিয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, আপনারা তো জানেনই! এ সময় চীন বাংলাদেশের এক বিশ্বস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রতিবেশী ও অংশীদার হিসেবে সবসময় পাশে থাকবে বলে আশ্বাস দেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও। বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা করতে চীন অভিজ্ঞতা বিনিময়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, দুর্যোগ প্রতিরোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহযোগিতা জোরদারের প্রস্তুতি রেখেছে বলে তিনি জানান। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীন বাংলাদেশের পাশাপাশি এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও একত্রে আধুনিকতা অর্জন এবং এশিয়ার উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবনে অবদান রাখতে চায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাষ্ট্রদূত জানান, সম্প্রতি কুনমিংয়ে চীন-বাংলাদেশ-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে বাস্তব অগ্রগতি অর্জনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক দক্ষিণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের মূল অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করে ইয়াও বলেন, বাংলাদেশ সবসময়ই চীনের প্রতিবেশী কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় এবং বাইরের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আসছি।
এ সময় ‘এক চীন’ নীতির প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার ও চীনের মৌলিক স্বার্থ ও প্রধান উদ্বেগে দৃঢ় সমর্থনেরও প্রশংসা করেন তিনি। ত্রিপক্ষীয় এই উদ্যোগে কেন শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, বাকি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে নয়-এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশকেও এ উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত করেছে। তবে তারা কেমন সাড়া দিয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
তিস্তা প্রকল্পের জন্য প্রস্তুত চীন, সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের : তিস্তা নদী পুনর্বাসন ও বহুমুখী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিলে চীন দ্রুত প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারবে। ঢিক্যাব টকে রাষ্ট্রদূত বলেন, তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন সব ধরনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত। এখন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের হাতে। দীর্ঘদিন ধরেই তিস্তা নদীকে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ পানি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে। চীনের অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আলোচনা চললেও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
চিকিৎসা নিতে প্রতি মাসে ৪০-৫০ বাংলাদেশি রোগী চীন যাচ্ছে : ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা জোরদার করেছে চীন। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে ৪০-৫০ জন বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে চীন যাচ্ছে। আগে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য পাঁচটি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হলেও এখন চীনের সব হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেয়া যাচ্ছে। প্রসঙ্গত: চলতি বছরের ১০ মার্চ চিকিৎসার উদ্দেশে বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম দল কুনমিং যায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত চীনে চিকিৎসা নিতে যাওয়াদের পরিসংখ্যান জানতে চাওয়া হয় ইয়াও ওয়েনের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন বাংলাদেশি চীনে চিকিৎসা নিতে গেছেন এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না। তবে প্রতি মাসে গড়ে ৪০-৫০ জন বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে চীন যাচ্ছে। সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। আগে বাংলাদেশির চিকিৎসার জন্য পাঁচটি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হলেও এখন চীনের সব হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে হাসপাতাল স্থাপন করবে চীন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত মার্চে চীনের তিনটি সরকারি এবং একটি বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য ঠিক করে দেয়া হয়। পরে আরও একটি হাসপাতাল যুক্ত করা হয়।
বিগত ১০ বছর বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগে বাধা দেয়া হয়েছিল: বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, বিগত সরকারের শেষ ১০ বছরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে চীনের যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের চীন সফর প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, খোলাখুলিভাবে বললে, গত ১০ বছরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সময় এসেছে, তাই তারা পুনরায় যোগাযোগ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তারা এ ধরনের সফর বিনিময় ও যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করতে চায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে কীভাবে বাধা দেয়া হতো-এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াও ওয়েন সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি।
তবে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, গত কয়েক বছরের পরিস্থিতি কেমন ছিল, সেটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকেরা অনুধাবন করতে পারেন। তিনি কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা উপস্থিত সাংবাদিকেরা বোঝেন। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বাংলাদেশি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আমন্ত্রণে এই সফরগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২২ জুন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল চীনে পাঁচ দিনের সফরে যায়। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বেগম সেলিমা রহমান, জহির উদ্দিন স্বপন, ইসমাইল জাবিউল্লাহ, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলসহ ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধিদল ১১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত চীন সফর করে। এই প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন ৯ জন। এটিকে একটি স্বতন্ত্র সফর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীনে ১১ দিনের সফরে যায়। এই সফরে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্য আটটি রাজনৈতিক দলের ২২ জন নেতা, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক ছিলেন।