মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের একের পর এক বৈঠক: নির্বাচন নাকি বিকল্প কূটনীতি

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:১৬ পিএম

গত সপ্তাহে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচন নাকি বিকল্প কূটনীতি? মার্কিন কূটনীতিক ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের (ঢাকায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত) একের পর এক বৈঠক ঘিরে দেশ-বিদেশের কূটনৈতিক মহলে এমন প্রশ্ন উঠেছে। তার এমন বৈঠকের পরপরই এনসিপি এবং জামায়াত নেতাদের নির্বাচন সংক্রান্ত মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ভোট কবে? তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। এমন কোনো শক্তি নেই এটি প্রতিহত করবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব দপ্তর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চাই। আশা করছি সেটি সবার সহযোগিতায় সম্ভব হবে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভূ-রাজনীতির অন্দরে রাশিয়া-ভারত-চীন জোট যেভাবে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের মাটি পাকিস্তানের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ মার্কিন কূটনীতি পাকিস্তানে কিঞ্চিৎ সফল হলেও বাংলাদেশের মাটিতে ভারত ও চীনের কারণে এখনো সেই অর্থে সাফল্য পায়নি। সম্প্রতি পাকিস্তানে বালুচিস্তান বিদ্রোহ দমাতে বালুচ লিবারেশন আর্মিকে (বিএলএ) জঙ্গি ঘোষণা করলেও তাতে এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পাবে না যুক্তরাষ্ট্র এবং তা বুঝে বাংলাদেশে বিকল্প জমি তৈরি করতে চাইছে ক্ষমতাধর দেশটি। এদেশে জমি শক্ত করতে পারলে, তারা ভারত ও চীনকে সহজে নজরদারি করতে পারবে। পাশাপাশি ভারত যেভাবে পাকিস্তানকে সামলাতে তৈরি হচ্ছে তাতে করে মার্কিনিদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বেড়েছে।
তারা বলেন, গতকাল ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাকিস্তান ইস্যুতে মোদীর হুঁশিয়ারি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সবমিলিয়ে ভূ-রাজনীতির এই চালচিত্রে ভারত যেভাবে ট্রাম্পের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে তাতে এই অঞ্চলে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। পাশাপাশি ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক ফলপ্রসূ হোক বা না হোক-বাংলাদেশকে আমেরিকার চাই। আর এ কারণেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে জনসংযোগ তৈরিতে তৎপর মার্কিন কূটনীতিক।
জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম. সাফিউল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, অন্তবর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, কারা বিরোধী দলে বসবে, তাদের ব্যবসা, বিনিয়োগের পলিসি কেমন হবে-তা জানার জন্যই তিনি বৈঠক করছেন এবং এই বৈঠকগুলো প্রকাশ্যে হচ্ছে, গোপনে নয়। যদি বৈঠকগুলো গোপনে হতো তাহলে সন্দেহের কারণ থাকত।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন গত এক মাসে ঢাকা ও লন্ডনে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক দল, কমিশন, বিচার বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে আলোচ্য ছিল ভূ-রাজনীতি, নির্বাচন, রাজনৈতিক সংস্কার, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং বিচারিক সহযোগিতা। গত বছর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই রাজনীতির নতুন মেরূকরণ নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীনসহ বিদেশি কূটনীতিকরা বৈঠক অব্যাহত রেখেছেন। তবে সম্প্রতি গত এক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণার পর এ তৎপরতা আরো বেড়েছে।
হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের এ তৎপরতা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গত কয়েকবারের মতোই এবারও যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে নজর রাখছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখানে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্রহ যেমন রয়েছে, তেমিন গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপিও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। নির্বাচন, সংস্কারসহ নানা বিষয়ে বিএনপি কূটনীতিকদের কাছে তাদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে। দলটির সঙ্গে দেশে অনেকবার বৈঠক করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বড় রাজনৈতিক পক্ষ বিএনপি। এর মধ্যে সরকার নির্বাচনের সময় জানিয়েছে। আর কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি, সুশাসন এবং গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের আগ্রহ বাড়ছে। বিগত নির্বাচনগুলোর সময়েও তারা সেই সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে। নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয় এ নিয়ে তারা সবপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এবারও তাই করছে। বিদেশিরা মনে করছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি এবার বড় রাজনৈতিক পক্ষ।
তাদের মতে, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, ভারত-চীন-রাশিয়ার নতুন মেরূকরণ সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তাদের এক ধরনের প্রভাব তৈরি করতে চায়। ফলে বিএনপিকে সম্ভাব্য নতুন সরকারের স্থানে ভেবে তারা নিজেদের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে চায়। বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আগ্রহ নতুন নয়। কিন্তু এবারের সক্রিয়তা ও সময়সীমা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিফলন, তেমনই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও একটি বার্তা অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিশ্ব এখন প্রত্যাশার চাপে রাখছে।
এর মধ্যে গত সপ্তাহে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রে তৎপরতার বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসে। যদিও তারেক রহমান লন্ডনে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, সরকার গঠনে তাদের পরিকল্পনা, দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, অভ্যুত্থানের পর থেকে নানা কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম তারেক রহমান। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনপ্রিয় দল হিসেবে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি বিএনপির। ক্ষমতায় গেলে দলটি কী করবে, তাদের পরিকল্পনা কী সেই আগ্রহ থেকে তার সঙ্গে বৈঠক করছেন বিদেশিরা।