জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া দলগুলো পাবে ‘বৃহস্পতিবারের মধ্যে’

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২০ এএম

কমিশন মোট ৩০টি রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত চাইলেও ২৬টি দল সময়মতো মতামত জমা দিয়েছে। ছবি : সংগৃহীত
জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া বৃহস্পতিবারের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
সংস্কার প্রশ্নে দীর্ঘ সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে আগে প্রণীত প্রাথমিক খসড়া থেকে তৈরি হয়েছে পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া। এরপর প্রাপ্ত মতামত অন্তর্ভুক্ত করে প্রস্তুত করা হয়েছে চূড়ান্ত খসড়া।
কমিশন মোট ৩০টি রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত চাইলেও ২৬টি দল সময়মতো মতামত জমা দিয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট মতামত দেয়নি। তবে কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা পবন চৌধুরী জানিয়েছেন, তারা শিগগিরই মতামত জমা দিতে পারে।
এদিকে সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন প্রশ্নে আপত্তি জানিয়ে সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের চার দল দ্বিতীয় দফার আলোচনার অংশ নিলেও খসড়ায় অসংগতির অভিযোগ এনে লিখিত মত দিয়েছে। তাদের দাবি, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের সুযোগ থাকলে সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ জাসদও বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। দলটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদকে কোনোভাবেই সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া যাবে না এবং ক্ষুব্ধ কেউ আদালতে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে না। এছাড়া সাংবিধানিক সংশোধনী অবশ্যই জাতীয় সংসদ ও সম্ভাব্য উচ্চকক্ষে পাস করতে হবে বলে জানিয়েছে তারা।
ঐকমত্য কমিশনের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহীন হোসেন প্রিন্স বলেন, সনদের যে সব বিষয়ে শতভাগ ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন হোক। আর যেগুলো সংবিধান সংশোধনের বিষয়, সেগুলো আগামী সংসদ করবে।
একই বৈঠকে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ স্পষ্টভাবে জানান, সংবিধান থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হলে তারা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না।
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, বৃহস্পতিবারের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে স্বাক্ষরের জন্য সনদের চূড়ান্ত কপি পৌঁছে দেওয়া হবে। তার আশাবাদ, অধিকাংশ দলই এতে স্বাক্ষর করবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। এরপর থেকে ধাপে ধাপে সংলাপ, মতামত গ্রহণ ও খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। কোরবানির ঈদের আগেই প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় দফার আলোচনায় ২০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মতবিনিময় হয়।
কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ায় উল্লেখিত অঙ্গীকারনামায় জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃতি, সংবিধান সংশোধনের প্রতিশ্রুতি, শহীদ ও আহতদের মর্যাদা ও সহায়তা নিশ্চিতকরণসহ আটটি প্রতিশ্রুতি যুক্ত করা হয়েছিল।
তবে চূড়ান্ত খসড়ায় কী কী পরিবর্তন এসেছে তা এখনো প্রকাশ করেনি কমিশন। বৃহস্পতিবারের মধ্যে সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে যাবে, এরপর জানা যাবে কোন দল সনদে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়।
আরো পড়ুন : ভোটের সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে: প্রধান নির্বাচন কমিশনার
এর আগে রজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো ‘পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ায়’ যে অঙ্গীকারনামা ছিল, সেখানে যে আটটি প্রতিশ্রুতির কথা বলা ছিল-
১) জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
২) এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ; তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছি বিধায় এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করব এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
৩) এই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
৪) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ ’-এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
৫) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
৬) আমরা ঐকমত্যে স্থির হয়েছি যে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত; ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৭) আমরা সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করছি যে, রাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
৮) আমরা এই মর্মে একমত যে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর যে সকল প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
এই সমন্বিত খসড়ার ওপর দলগুলোর মতামত নিয়ে যে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তা প্রকাশ করেনি ঐকমত্য কমিশন।