×

জাতীয়

জুলাই সনদ

বিএনপির কাঠগড়ায় কমিশন

Icon

হরলাল রায় সাগর

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৯ পিএম

বিএনপির কাঠগড়ায় কমিশন

ছবি : সংগৃহীত

ভোটের মাঠে হাঁটা সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। বিশেষ করে সরকারকে একচেটিয়া সমর্থন দেয়া বিএনপি এখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ প্রতিবেদন দিয়েছে, তাকে জনগণ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি।

দলটির অভিযোগ, সংস্কার ও সনদ বাস্তাবায়নে দলটি যে ‘ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে তা সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে সুপারিশে। কমিশনের এই অবস্থান গণতান্ত্রিক ধারায় উত্তরণে নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা বলে মনে করছে দলটি। এমনকি সরকার প্রতিশ্রুত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যত্যয় ঘটলে এর দায়ভার প্রধান উপদেষ্টার ওপর বর্তাবে বলেও হুঁশিয়ারি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা চলছে।   

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই কমিশনের সভাপতি এবং অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ সহসভাপতি। সাত সদস্যের এই কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করে। ১৭টি বিষয়ে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। বাকি ৬৭টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে; দিয়েছে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’।

গত ১৭ অক্টোবর ২৫টি দল এই সনদে সই করে ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। সরকারের অংশীজন এনসিপি এবং সিপিবিসহ ৪টি দল এতে সই করেনি। কিন্তু এই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য চলে আসছে। এর আইনি ভিত্তি দিতে আদেশ, অধ্যাদেশ, গণভোট ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে অনড় অবস্থানে থাকায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি।

পরবর্তীতে রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সুপারিশমালা তৈরি করে। এই সুপারিশ প্রতিবেদন গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু এই সুপারিশের কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে ওই দিনই আপত্তি তোলে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি গণভোট আর নির্বাচন একই দিনে হবে দুটো ব্যালটের মাধ্যমে। তার আগে গণভোট নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটা চেষ্টা গ্রহণ করেছে। যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, সেখানে সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। দফায় দফায় নোট অব ডিসেন্ট দেয়া আছে। কিন্তু সুপারিশমালার সঙ্গে যে সংযুক্তিগুলো দিয়েছে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই। তাছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদের নামে একটা আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনে এ বিষয়ে কখনো আলোচনা হয়নি।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এই সুপারিশ নিয়ে আরো কঠোর সমালোচনা করেছে একসময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এই জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে তিনি স্বাক্ষরও করেছেন। কিন্তু সরকারের কাছে দেয়া কমিশনের সুপারিশে নোট অব ডিসেন্ট সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে। এতে তারা বিস্মিত। তাহলে ঐকমত্য কমিশনটা করা হয়েছিল কেন? এটা ঐক্য হতে পারে না। জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। অবিলম্বে এ বিষয়গুলো সংশোধন করতে হবে। অন্যথায় এটি ঐক্যের বিপরীতে যাবে বলেও হুঁশিয়ারি করেন তিনি। 

প্রধান উপদেষ্টার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আপনি কিন্তু এইবার জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ। সত্যিকার অর্থে যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট আসবে, সেই পার্লামেন্ট এই দেশের সংকটগুলো সমাধান করবে। কিন্তু যদি সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয় বা কোনো ব্যত্যয় ঘটে তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই বহন করতে হবে। এ কথাটা আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই।

মির্জা ফখরুল বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে, ততই বিভক্ত বাড়ছে। বিভক্ত হয়ে পড়াটা, এটা কারা করছেন, কেন করছেন, এটাও উপলব্ধি করতে হবে। মিডিয়াতে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে কতগুলো পক্ষ নিয়ে একেবারে নেমে যাওয়া হয়। প্রতিপক্ষকে একেবারে পুরোপুরি ঘায়েল করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়।

কমিশন ও সরকারের পদক্ষেপগুলোর সঙ্গে বিএনপির প্রত্যাশা মেলে না মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিএনপি হতাশ। তিনি বলেন, গত ১৭ অক্টোবর যে দলিল স্বাক্ষর হয়েছে, তার সঙ্গে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশ পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বলা হলো ৪৮টি দফার ওপর গণভোট করা হবে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি। এতদিন কেন এত আলোচনা, এত কসরত করা হলো, তা প্রশ্নবিদ্ধ।

তিনি বলেন, যেগুলো ঐকমত্য হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। জুলাই সনদ যেটা স্বাক্ষর হয়েছে সেটা নেই। আছে কমিশন ও দুই-একটি দল যে প্রস্তাব দিয়েছে তা। কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু যা প্রস্তাব এসেছে, তাতে জাতিতে বিভক্তি ও অনৈক্য সৃষ্টি হবে, কোনো ঐকমত্য হবে না। তাদের উদ্দেশ্য আমরা জানি না, তারা কী অর্জন করতে চায় তা আমরা জানি না।

এর আগে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫’ এর খসড়া নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। গত ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে পাস হওয়া ওই সংশোধনীতে ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, জোটবদ্ধ হলেও ভোট করতে হবে নিজ দলীয় প্রতীকে। অর্থাৎ জোট মনোনীত প্রার্থী হলেও তাকে ভোট করতে হবে নিজের দলের প্রতীকে। আরপিওর ২০ ধারার সংশোধনীর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ২৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. ইসমাঈল জবিউল্লাহ সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি এই সংশোধনের সঙ্গে একমত নয়। এই সংশোধনী বা পরিবর্তন বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সংশোধনী থেকে সরে এসে আরপিওর আগের বিধান বহাল রাখার অনুরোধ জানিয়ে আমরা সিইসির কাছে আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়েছি। তিনি বলেন, জোটের বা নিজেদের দলের প্রতীক নিয়ে ভোট করা গণতান্ত্রিক অধিকার। কমিশনের বৈঠকেও এই বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে। 

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জোটবদ্ধ যেকোনো রাজনৈতিক দল তাদের স্বাধীনভাবে নিজস্ব প্রতীকে বা জোটের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে। হঠাৎ করে বলা হলো, জোটবদ্ধ হলেও তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। দেখলাম আরেকটি রাজনৈতিক দল সেটাকে সমর্থন করছে। এটা আমরা আশা করি না।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সিংগাইরে মাদ্রাসায় বসার বেঞ্চ-টুল উপহার দিলো জেসিআই মানিকগঞ্জ

সিংগাইরে মাদ্রাসায় বসার বেঞ্চ-টুল উপহার দিলো জেসিআই মানিকগঞ্জ

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

ড. ইউনূস হতে পারেন জাতিসংঘের মহাসচিব!

ড. ইউনূস হতে পারেন জাতিসংঘের মহাসচিব!

গণভোটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা : আইন উপদেষ্টা

গণভোটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা : আইন উপদেষ্টা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App