ড. ইউনূস হতে পারেন জাতিসংঘের মহাসচিব!
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৮ পিএম
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মানুষের মনে এক গভীর আশা জেগেছিল। সবাই বিশ্বাস করেছিল, এই সংস্থা পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর মানবাধিকারের লঙ্ঘন দূর করবে। যে দেশগুলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তির ভিত্তি গড়ে তুলেছিল, তারাই ছিল এই সংস্থার চালিকা শক্তি। মানুষ ভেবেছিল, জাতিসংঘ হবে মানবতার আশ্রয় এবং বিশ্ব ঐক্যের প্রতীক।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আশার আলো ম্লান হয়ে গেছে। পূর্ব ও পশ্চিমের ঠাণ্ডা যুদ্ধ, শক্তির ভারসাম্য আর রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপড়েনে সংস্থার কার্যকারিতা কমে গেছে। আজকের পৃথিবী গভীর অস্থিরতায় ভরপুর। যুদ্ধ, দারিদ্র্য, পরিবেশের ক্ষতি, বৈষম্য আর নৈতিক অবক্ষয়ে মানুষ বিপর্যস্ত ও পথহারা। যে জাতিসংঘ এক সময় মানবতার আশ্রয় ছিল, আজ তা মানুষের আস্থা হারিয়েছে এবং নানা জটিলতার কারণে বিশ্বের সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান দিতে পারছে না।
এই অস্থির সময়ে পৃথিবী খুঁজছে এমন এক নেতৃত্বকে, যিনি শুধু রাজনীতি বোঝেন না, মানুষকেও বোঝেন। সেই সম্ভাব্য নেতৃত্বের মুখ হতে পারেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূসের জীবনগাথা কেবল অর্থনীতি বা উন্নয়নের ইতিহাস নয়। এটি মানুষের মুক্তির গল্প। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য কোনো নিয়তি নয়। সুযোগ পেলে মানুষ নিজেই নিজের জীবনের পথ গড়ে নিতে পারে। তাঁর প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ ধারণা কোটি মানুষের জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছে। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পরও তিনি থেমে যাননি। বরং সমাজ ব্যবসা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে নতুন এক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছেন, যা আজ বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়।
জাতিসংঘের মহাসচিবের পদটি কেবল প্রশাসনিক নয়। এটি নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। বর্তমান বিশ্বে সেই নৈতিকতার ঘাটতিই সবচেয়ে প্রকট। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতিসংঘ পেতে পারে এক নতুন দিশা, এমন একটি ধারণার দিকে যেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নির্গমন শূন্যে নামানোর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে। তাঁর “Three Zero World” ভাবনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এবং বাস্তবমুখী।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা ছিল এক মানবিক উদ্যোগের দৃষ্টান্ত। দুর্নীতি, অবিশ্বাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙনের মধ্যেও তিনি চেষ্টা করেছেন শান্তিপূর্ণ এবং নৈতিক পথ দেখাতে। তাঁর নেতৃত্বে মানুষ দেখেছে দায়িত্ব এবং সহমর্মিতার এক নতুন উদাহরণ, যেখানে ক্ষমতার চেয়ে বড় ছিল আস্থা এবং ন্যায়বোধ। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছে এক অনন্য বাস্তব শিক্ষা, যা বৈশ্বিক নেতৃত্বে বিরল সম্পদ।
আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাবও অনস্বীকার্য। বহু রাষ্ট্রনেতা, চিন্তাবিদ এবং মানবাধিকারকর্মী তাঁর চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে তাঁর সমাজ ব্যবসা এবং ন্যায্য অর্থনীতির প্রস্তাবনা ইতিমধ্যেই বহু দেশে নীতিমালায় জায়গা পেয়েছে। তাঁর এই নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা জাতিসংঘের প্রতি মানুষের আস্থা পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এখন জাতিসংঘের ভেতরেও পরিবর্তনের সময় এসেছে। ভেটো সংস্কৃতি, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং অতিরিক্ত আমলাতন্ত্র সংস্থাটির প্রাণশক্তি দুর্বল করে ফেলেছে। বড় রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষায় ভেটো ব্যবহারের প্রবণতা অনেক সময় মানবাধিকার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন সংস্কারের দাবি উঠছে। এমন বাস্তবতায় ড. ইউনূসের মতো নৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন, যিনি প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে মানবিকতা এবং ভারসাম্যের পথে ফেরাতে পারেন।
ড. ইউনূসের দর্শনের মূলে রয়েছে এক সহজ বিশ্বাস, মানুষ জন্মগতভাবে সৃষ্টিশীল এবং নৈতিক। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষকেও পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে দেখেছেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতিসংঘকে আবারও “জনগণের জাতিসংঘ” হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে, যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা এবং অধিকারই হবে অগ্রাধিকার।
আজ পৃথিবী নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায়। এমন একজন নেতৃত্ব, যিনি ন্যায়ের সঙ্গে বাস্তবতার এবং মানবতার সঙ্গে নীতির মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই নেতৃত্বের প্রতীক হতে পারেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, পরিবর্তন সম্ভব যদি আমরা মানুষের প্রতি আস্থা রাখি। জাতিসংঘ যদি সত্যিই মানবতার প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, তবে এখনই সময় এমন নেতৃত্বকে স্বাগত জানানোর, যিনি বিশ্বাস করেন মানুষই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

