×

জাতীয়

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভারত কেন সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে?

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩১ পিএম

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভারত কেন সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে?

লালমনিরহাট সীমান্তে বিজিবির একটি বিওপি। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ‘চিকেনস নেক’ হিসেবে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর ঘিরে ভারতের সামরিক তৎপরতা বাড়ার সংবাদ বিশ্লেষক মহলে নতুন আলোচনা সৃষ্টি করেছে। আসাম ও উত্তর দিনাজপুরে দুটি নতুন আর্মি স্টেশন তৈরির উদ্যোগ, সীমান্তে বিএসএফের বাড়তি নজরদারি এবং সাম্প্রতিক মহড়ার কারণে এ অঞ্চলের কৌশলগত অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এই তৎপরতার প্রধান লক্ষ্য হলো শিলিগুড়ি করিডোরকে সুরক্ষিত করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন ভূরাজনৈতিক অবস্থাও এই তৎপরতার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্লেষকদের ভাষায়, শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা—কারণ এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করে এবং পাশাপাশি চীনের প্রভাবও এখানে বড় বিবেচ্য বিষয়।

এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি ওঠে যে লালমনিরহাটের ৬২ কিলোমিটার সীমান্ত ভারতের দখলে চলে গেছে। বিবিসি বাংলা সরেজমিনে লালমনিরহাটে গিয়ে পরিস্থিতি যাচাই করে এবং বিজিবি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এ দাবির সত্যতা খুঁজে দেখে।

লালমনিরহাট জেলার ৩৪৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সম্প্রতি ছড়ানো গুজব বিষয়ে ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম বলেন, এটা সম্পূর্ণ গুজব। বানোয়াট খবর। স্থানীয়দের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এটি ছড়ানো হয়েছে। বিজিবি নিয়মিত টহলে আছে এবং এলাকার মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করছে। তিনি জানান, বিএসএফের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে এবং যৌথ টহলও স্বাভাবিকভাবে চলছে।

মোগলহাট সীমান্তে গিয়ে দেখা যায়, ধরলা নদীর তীরে স্থানীয়রা আগের মতোই মাঠে কাজ করছেন, নৌকা চালাচ্ছেন। গ্রামবাসী নিশ্চিত করেছেন যে কোনো জমি দখল বা সৈন্য অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। তবে তারা স্বীকার করেছেন, বিএসএফ আগের তুলনায় টহল বাড়িয়েছে, টহল দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, অস্থায়ী চৌকিও বেড়েছে। ১১ নভেম্বর বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি আহত হওয়ার ঘটনাও স্থানীয়দের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

সীমান্তের কাছে ভারত কী করছে

ভারত আসামের ধুবরি এবং উত্তর দিনাজপুরের চোপরায় দুটি নতুন সেনা ঘাঁটির নির্মাণকাজ শুরু করেছে, এগুলো বাংলাদেশের সীমান্তের অত্যন্ত নিকটে। এর আগে এ বছরের শুরুতে শিলিগুড়ি করিডোর এলাকায় ভারতের তিন বাহিনীর সম্মিলিত বড় ধরনের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জী বিবিসিকে জানান, শিলিগুড়ি করিডোর একটি অত্যন্ত কৌশলগত এলাকা হওয়ায় সক্ষমতা বাড়ানো ভারতীয় সেনাদের স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ সক্ষমতা বৃদ্ধি। বিএসএফ সীমান্তের দায়িত্বে থাকে, আর্মি ডিপ্লয়মেন্ট সাধারণত হয় না। এখানে কিছু স্থাপনাকে পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।

ডোকলাম এলাকা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর পর্যন্ত একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতি আছে বলে ভারতের ধারণা, যা তাদের প্রস্তুত থাকতে বাধ্য করছে। তবে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে এ পদক্ষেপের সরাসরি যোগ নেই বলে মনে করেন।

বাংলাদেশে কী মূল্যায়ন

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ সামরিক ঘাঁটির অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। তিনি বলেন, এটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত মুভমেন্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এটা প্রশ্নবিদ্ধ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়। কোনোকিছু যদি আমার বর্ডারে দেখি যেটা আমাদের সার্বভৌমত্ব বা বর্ডার রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে, বর্ডারের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে এই নিয়মের বহির্ভূত কিছু হচ্ছে- তখন সেটা আমার উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে যদি তারা কিছু করে সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

বাংলাদেশের সাবেক মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলছেন, ভারত কৌশলগতভাবে খুব হিসাব করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মতে, তিনটি বিষয় এতে প্রভাব ফেলছে—শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা, চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিরোধ এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভারতের কৌশলগত উদ্বেগ।

তিনি বলেন, অন্যদিকে যদি জিও-স্ট্র্র্যাটিজিক জিনিসগুলো চিন্তা করি, যে চাইনিজ যে এক্সপানশন নীতিতে আছে একদিকে সিপ্যাক- চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর, এদিকে সিম্যাক-চায়না মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর করেছে। ফলে তার (চীন) যে এক ধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এটা যদি সে এইদিকে কানেক্ট করে ফেলে, তাহলে তার যে এই অঞ্চলে, সাউথ এশিয়াতে তার যে প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী যাকে আমরা বলি, তাকে কিন্তু সে দুর্বল করে ফেলতে পারে। এইটাকে কিন্তু ইন্ডিয়ার মাথায় রাখতেই হচ্ছে।

গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সামরিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে যা ভারতের জন্য পছন্দের নয় এবং তারা এই যোগাযোগকে সন্দেহের চোখে দেখে বলে অনেকে মনে করেন।

এছাড়া শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর ও তিস্তা প্রকল্পে চীনের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতিও ভারত পছন্দ করে না এমন বিশ্লেষণ জানাচ্ছেন নাঈম আশফাক চৌধুরী।

তার মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একইসঙ্গে কিছু প্রকল্প, বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজ ভারতের উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকতে পারে। আলোচনা হচ্ছে যে চীনকে পুরো তিস্তা প্রকল্প ১০০ বছরের চিন্তা করে দিতে পারে কি না, সেখানে শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে চীনের অবস্থানকে ভারত এক ধরনের 'থ্রেট' মনে করতে পারে। এটাও সীমান্তে তাদের সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর একটা কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল নাইম আশফাক চৌধুরী ভারতের সামরিক তৎপরতাকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে দেখেন না। তবে সীমান্তের কাছে এ সামরিক পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

ভারতের সেনাঘাঁটি তৈরি উদ্যোগকে সামরিক পরিভাষায় বাংলাদেশের জন্য 'গ্রে জোন ব্যাটল' হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি।

এর অর্থ সরাসরি যুদ্ধ না করেও সামরিক মহড়া, অস্ত্র, সৈন্য সামন্ত হাজির করে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হবে যাতে প্রতিপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে ভাবনা-চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়।

তিনি বলেন, এটাকে মনে হচ্ছে গ্রে জোন ব্যাটল ফর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলা। বিষয়টাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে–– ভারতের স্বার্থের বিপরিতে চলে যেতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরাও যেন হুমকি অনুভব করি।

তিনি মনে করেন, ৫ই অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রয়েছে, এখনো নির্বাচিত সরকার আসেনি এবং আমাদের যে নিরাপত্তার যে অবস্থাটা আছে সেই অবস্থা থেকেও তারা কিছুটা থ্রেট ফিল করতে পারে।

তিনি বলেন, সব মিলিয়ে আমি এটাকে অস্বাভাবিক কোনো জিনিস দেখছি না। বাট বাংলাদেশ শুড ওয়ার্ক ভেরি কেয়ারফুলি। লাইক মিলিটারি ডিপ্লোমেসি, কানেকটিভিটি উইথ মিলিটারি টু মিলিটারি সেটা কন্টিনিউ করতে হবে।

বাংলাদেশে ৫ই অগাস্ট পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যুত্থানের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তিগুলো ভারতবিরোধী একটি অবস্থান দেখা যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বক্তব্যে ভারতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপঙ্কর অবশ্য বলছেন, বাংলাদেশকে সামরিক দিক থেকে ভারত কোনো হুমকি হিসেবে দেখে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে কোনোরকম একটা মিলিটারি থ্রেট হতে পারে এটা আমরা একসেপ্ট করি না।

বাস্তবতা হলো, ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান সীমান্তে নিয়মিত গণ্ডগোল চলে। পূর্বাঞ্চল সীমান্তে বাংলাদেশকে ভারত শত্রুজ্ঞান করেনি যার পেছনে সাহস যুগিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে কৌশলগত অবস্থান থেকে অন্য কেউ যদি ব্যবহারের সুযোগ নেয় সেটা ভারতের দুশ্চিন্তার জায়গা, বলছেন বিশ্লেষকরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

নির্বাচনের সময় যতদিন মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

নির্বাচনের সময় যতদিন মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

যুদ্ধ নয়, স্বচ্ছতার নতুন যুগ: ড্রোন প্রযুক্তিতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা

যুদ্ধ নয়, স্বচ্ছতার নতুন যুগ: ড্রোন প্রযুক্তিতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা

ঢাকা-১৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন প্রবাসী কাজী এনায়েত উল্লাহ

ঢাকা-১৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন প্রবাসী কাজী এনায়েত উল্লাহ

সবজিতে ফের অস্বস্তি, ঝাঁজ বহাল পেঁয়াজের

সবজিতে ফের অস্বস্তি, ঝাঁজ বহাল পেঁয়াজের

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App