নরওয়ের নির্বাচন ও বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় দিক
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:২১ পিএম

নরওয়ের নির্বাচন ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন রহমান মৃধা
শীঘ্রই বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ নরওয়েতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটি একটি তেলসমৃদ্ধ দেশ, যা নরওয়ের মানুষকে তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক, নিশ্চিন্ত এবং মানসম্মত জীবনযাপন করতে সাহায্য করেছে। নরওয়েজিয়ানরা নিজেরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করে, আর বাকি অনেক কাজ আউটসোর্স (Outsourcing) করে দেয় সুইডেনসহ অন্যান্য দেশের শ্রমশক্তির কাছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা এই ব্যবস্থাকে একেবারে স্বাভাবিকভাবে এবং আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছে।
প্রশ্ন আসে—
• এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
• নরওয়েকে কীভাবে এতটা অনন্য (Unique) করা হয়েছে?
• আমরা এখান থেকে কী ধরনের শিক্ষা (Lesson) নিতে পারি?
• এবং বাংলাদেশ নরওয়ের অভিজ্ঞতা থেকে কীভাবে বাস্তব শিক্ষা নিয়ে নিজেদের পথ নতুনভাবে সাজাতে পারে?
নরওয়েতে নির্বাচন আসলে শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি দেশের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনার প্রতিফলন। দেশটি আজ বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র, যদিও তাদের জনগণ সংখ্যা মাত্র প্রায় পাঁচ মিলিয়ন। তেল ও গ্যাসের প্রাচুর্য তাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেছে, তবে শুধু সম্পদ নয়—দক্ষ নেতৃত্ব, সুশাসন এবং জনগণের আস্থাই নরওয়েকে সত্যিকারের সফল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
নরওয়েজিয়ানরা ভোট দিতে গেলে প্রশ্ন করে না, “আমরা টিকে থাকতে পারব কি না।” বরং তারা ভাবেন, “কীভাবে আমরা আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি?”
অন্যদিকে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের জন্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হলো—আমরা কি সেই মৌলিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারব, যেখানে জনগণ রাষ্ট্রের ওপর আস্থা রাখতে পারবে এবং দেশ দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলভাবে উন্নয়ন করবে?
নরওয়ে থেকে শেখার বিষয়গুলো আমরা ধারাবাহিকভাবে (A–Z) দেখতে পারি—
A – দায়িত্বশীল নেতৃত্ব (Accountable leadership)
রাজনীতিবিদরা জনগণের অভিভাবকের মতো কাজ করেন। রাষ্ট্রের সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার না করে জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঞ্চয় করেন।
B – বিবেচক সিদ্ধান্ত (Bold decisions)
তেল আবিষ্কারের পরপরই কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল—সব আয় খরচ না করে একটি রাষ্ট্রীয় তহবিলে (Sovereign Fund) জমা রাখা।
C – দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ (Corruption control)
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জনগণের আস্থা নিশ্চিত করেছে।
D – গণতন্ত্র (Democracy)
একটি শক্তিশালী ও কার্যকর গণতন্ত্র যেখানে নির্বাচন ও জনমতই রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি।
E – জ্বালানি ও অর্থনীতি (Energy & Economy)
তেল ও গ্যাসের আয়কে অর্থনীতির উন্নয়নে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
F – ভবিষ্যৎ তহবিল (Future Fund)
নরওয়ের রাষ্ট্রীয় পেনশন ফান্ড (Government Pension Fund) বিশ্বের সবচেয়ে বড়। এটি আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখছে।
G – সুশাসন (Good governance)
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর ও নিয়ম-শৃঙ্খলাবদ্ধ। আইন মানা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত।
H – টেকসই উন্নয়ন (Holistic sustainability)
অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ একসাথে এগিয়েছে।
I – অবকাঠামো (Infrastructure)
সড়ক, রেল, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ও স্বাস্থ্যখাত আধুনিক ও জনগণের জন্য সহজলভ্য।
J – সমতা (Justice & equality)
আয়ের বৈষম্য সীমিত, ফলে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
K – জ্ঞান ও দক্ষতা (Knowledge & competence)
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষা সবার অধিকার।
L – নেতৃত্ব (Leadership)
নেতৃত্ব জনগণের আস্থার উপর দাঁড়িয়ে থাকে, ক্ষমতার জোরে নয়।
M – অভিবাসন (Migration)
বাহিরের শ্রমশক্তি ব্যবহৃত হয়, কিন্তু রাষ্ট্র নিশ্চিত করে যে নাগরিকদের সুরক্ষা অটুট থাকে।
N – জাতীয় ঐক্য (National unity)
নরওয়ে ছোট দেশ হলেও নাগরিকদের মধ্যে দৃঢ় জাতীয় পরিচয় ও ঐক্য রয়েছে।
O – সরকারি খাত (Public sector)
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহনসহ মৌলিক সেবায় শক্তিশালী সরকারি ভূমিকা।
P – রাজনীতিবিদদের ভূমিকা (Politicians’ role)
তাদের মূল দায়িত্ব দেশকে ভবিষ্যতমুখী পথে নেতৃত্ব দেওয়া, কেবল ক্ষমতা ধরে রাখা নয়।
Q – জীবনমান (Quality of life)
উচ্চ জীবনমান নরওয়ের মানুষের আসল অর্জন—কেবল অর্থ নয়, সুস্থতা, নিরাপত্তা ও সুখ।
R – সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Resource management)
প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় না করে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার।
S – সামাজিক নিরাপত্তা (Social security)
অসুস্থ, বেকার বা প্রবীণ—কেউ রাষ্ট্রের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত নয়।
T – আস্থা (Trust)
জনগণ রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে, আর রাষ্ট্রও নাগরিকদের বিশ্বাস করে।
U – শিক্ষা (Universal education)
উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিনামূল্যে। শিক্ষা সবার অধিকার।
V – কল্যাণ মডেল (Welfare model)
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও শক্তিশালী সামাজিক কল্যাণ একসাথে চলে।
W – কাজ ও জীবনের ভারসাম্য (Work-life balance)
কাজ জরুরি, কিন্তু জীবন আরও বড়। অবসর ও পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
X – বহিরাগত সংস্কৃতির প্রতি উন্মুক্ততা (Xenophobia absence)
অন্য সংস্কৃতি ও বিদেশিদের প্রতি তুলনামূলকভাবে সহনশীল মনোভাব।
Y – বৈদেশিক সম্পর্ক (Youthful diplomacy / International relations)
ছোট দেশ হয়েও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নরওয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
Z – শূন্য সহনশীলতা (Zero tolerance)
রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সম্পদের অপব্যবহার বা দুর্নীতির প্রতি কঠোর শূন্য সহনশীল নীতি।
নরওয়ে, সুইডেন ও অন্যান্য নর্ডিক দেশে নির্বাচনকালীন সময়ে একটি অনন্য ও অনুপ্রেরণামূলক প্রথা লক্ষ্য করা যায়। নির্বাচনী প্রচারণার সময়, সকল প্রধান রাজনৈতিক দল সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় অংশগ্রহণ করে একটি পাবলিক প্যানেলে। এখানে প্রতিটি দল ব্যাখ্যা করে তারা ক্ষমতায় এলে কী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। নাগরিকরা সরাসরি শুনতে পারে, প্রশ্ন তুলতে পারে এবং প্রত্যেক রাজনৈতিক অবস্থানের পার্থক্য নিজ চোখে দেখতে পায়। পুরো প্রক্রিয়াটি লাইভ সম্প্রচারিত হয়, যা নিশ্চিত করে যে নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো সর্বজনীনভাবে স্বচ্ছ এবং জনগণের কাছে স্পষ্ট।
বাংলাদেশে দীর্ঘ বছরেও কেন এমন স্বচ্ছ এবং প্রজ্ঞামূলক প্রচারণার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি—ভাবলেই বিস্মিত হতে হয়। এই ধরনের ব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে না; এটি জনগণকে সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে, নেতৃত্বের জবাবদিহি নিশ্চিত করে এবং ভোটের গুরুত্বকে প্রকৃত অর্থে পৌঁছে দেয়।
নরওয়ের নির্বাচন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃত সমৃদ্ধি কেবল অর্থনৈতিক সম্পদে নয়। এটি দায়িত্বশীল নেতৃত্ব, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের আস্থার উপর দাঁড়িয়ে থাকে।
বাংলাদেশের জন্য আজকের চ্যালেঞ্জ হলো—আমরা কি সেই কাঠামো গড়ে তুলতে পারব, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের আস্থা অর্জন করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি দৃঢ় ও স্থিতিশীল ভিত্তি রেখে যাবে?
নরওয়ে দেখিয়েছে যে সম্পদ কোনো অভিশাপ নয়, যদি তা স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা হয়। আমাদেরও সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা উচিত। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে—তেল ও গ্যাসের সমৃদ্ধ দেশ নরওয়েকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা কি যুক্তিসঙ্গত? প্রকৃতপক্ষে, তুলনা নয়, বরং শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরা প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রচুর যুবশক্তি রয়েছে, যা দেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। গ্যাস-তেল আছে, তবে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এই যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। যদি তাদের শক্তি, সৃজনশীলতা এবং উদ্যোগকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে দেশের জন্য এটি তেলের থেকেও মূল্যবান একটি সম্পদে পরিণত হতে পারে।
ভাবুন—যদি দেশের যুবশক্তিকে সঠিকভাবে আউটসোর্সিং (Outsourcing) করার সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে বৈদেশিক রেমিট্যান্স (Remittance) বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বিশাল অবদান রাখতে পারে। এটি শুধু অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না, বরং নতুন চাকরি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সংযোগের সুযোগও তৈরি করবে। সুতরাং যুবশক্তিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা মানে জাতির জন্য এক বিশাল, মূল্যবান ও স্থায়ী সম্পদ তৈরি করা, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধিকে স্থিতিশীল করবে।
বাংলাদেশ, এখনই নতুন করে ভাবার সময়।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন), [email protected]