×

মতামত

পারিবারিক সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, ভয়াবহ সামাজিক সংকট

Icon

দীপ্তি রানী সিকদার

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০২:২৯ এএম

পারিবারিক সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, ভয়াবহ সামাজিক সংকট

পারিবারিক সহিংসতা ও ভয়াবহ সামাজিক সংকট নিয়ে লিখেছেন দীপ্তি রানী সিকদার। ছবি: ভোরের কাগজ

বাংলাদেশে অনেক নারী পারিবারিক পরিমণ্ডলে পরিবারের সদস্য নিকট আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন এটি নতুন কোন ঘটনা নয়। অনেকেই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং পারিবারিক বিষয় কোনোভাবে বাইরে কাউকে বলা যাবে না ধরে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করে যান। খুব কম সংখ্যক নারী নিরুপায় হয়ে আইনের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনার আইনি প্রতিকারের জন্য পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ পাশ হয়। এই আইনের ৩ ধারায় পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তি দ্বারা পরিবারের অপর নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন এবং আর্থিক ক্ষতিকে বোঝায়। এ আইনে শুধু স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্যাতন সংক্রান্ত নয়, বরং পারিবারে যে কোনো সদস্যর বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনার আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে যে আইনি প্রতিকার আছে অনেকেই সে সম্পর্কে জানেন না। আবার অনেক ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩, ২০২০ ও ২০২৫) এর যৌতুকের জন্য নির্যাতন উল্লেখ করে ১১(গ) ধারায় মামলা করে থাকেন। মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির জন্য যে মামলা হতে পারে তা অনেকেই জানেন না।

বাংলাদেশ প্রতিকারের জন্য সহায়তার জন্য আসলেও তার জন্য ঐ ভুক্তভোগী নারীকেই দোষারোপ করা হয়। একজন নারী শেষ পর্যন্ত সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। নারীর শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের কথা বললেও যৌন সহিংসতার বিষয়ে একেবারেই বলেন না। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষিত নারী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার নারী অনেকেই জীবনে কোনো না কোনোভাবে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ও হচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতার ফলে একজন নারী ও শিশু কোনো না কোনো সময় মানসিক বিষণ্ণতায় ভোগেন, কর্মক্ষমতা হারান। এই ধরনের সহিংসতা পরিবারের শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক গতি হারায়। বর্তমান সময়ে পারিবারিক সহিংসতার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছে অথবা পালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো বা মা সন্তানদের হত্যার করে নিজে আত্মহত্যা করছে। অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতাকে পারিবারিক বিষয় পরিবারেই সমাধান করতে হবে মনে করলে হবে না। পারিবারিক সহিংসতার মূলে রয়েছে প্রচলিত জেন্ডারভিত্তিক ধারণা ও প্রথা যা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এর যৌথ জরিপ, ২০২৪ এর তথ্য অনুসারে জীবনে অন্তত একবার সহিংসতার শিকার হয়েছে ৭৬ শতাংশ নারীর মধ্যে নির্যাতনমূলক আচরণের শিকার ৬৮ শতাংশ, শারীরিক সহিংসতার শিকার ৪৭ শতাংশ, মানসিক নির্যাতনের শিকার ৩৭ শতাংশ, যৌন নিপীড়নের শিকার ২৯ শতাংশ, অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার ২০ শতাংশ এবং ৬২ শতাংশ নারী কখনো অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। সেইসাথে সহিংসতার শিকার প্রায় অর্ধেক নারীরা জানে না কোথায় সহযোগিতার জন্য যেতে হবে। এই ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে হলে নারীর প্রতি অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম। পারিবারিক সমস্যাকে অনেক সময় তুচ্ছ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সাথে সহিংসতার জন্য নারীকেই দায়ী করা হয় এবং দাম্পত্য কলহ নিরসনের জন্য দায়িত্বও নারীদের ওপর দেয়া হয়। এই দায়িত্ব শুধু নারীর নয় পুরুষেরও। পারিবারিক সহিংসতার যে অপরাধ সে বিষয়ে প্রচার করা। এই ধরনের সহিংসতা যে মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের জন্যও ক্ষতিকর, কেননা ঘরের সহধর্মিণী যখন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় তখন তার কর্মক্ষমতা কমে যায়, মানসিক অবসাদ দেখা দেয় এবং অনেক সময় চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাছাড়া পরিবারে অশান্তির কারণে শিশুদের যথাযথ বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয় যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর।

পারিবারিক সহিংসতাকে একটি তুচ্ছ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত সংকট নয়; এটি একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। এর সমাধানে বিচার বিভাগ অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সময় ও অর্থ ব্যয় করার চেয়ে পারিবারিকভাবে সমাধান করা উচিত বলে মনে করা হয়। এই ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ থাকলেও এর প্রয়োগের মাত্রা খুবই কম। আইনের কার্যকর বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই আইন বাস্তবায়নে দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমূহের আচরণ এবং মনোভাবের পরিবর্তন করার জন্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা। সরকারি পর্যায়ের এই আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনা। সরকারের জরুরি সেবা এবং জরুরি সহায়তা দেয়ার জন্য যে সব সার্ভিস আছে সে বিষয় প্রচার করা। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে রাষ্ট্রীয় জরুরি উদ্যোগ, কর্মকৌশল নির্ধারণে তার যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যক্তি হিসেবে কমিটমেন্ট প্রয়োজন যে আমি আমার পরিবারের সদস্যদের প্রতি কোনো প্রকার সহিংস আচরণ করবো না এবং কাউকে করতে দিব না। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীর প্রতি সহিংসতা কমতে থাকবে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ এবং হিজরা সম্প্রদায়ের মানুষের সম-অধিকার নিশ্চিত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

পারিবারিক সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, ভয়াবহ সামাজিক সংকট

পারিবারিক সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, ভয়াবহ সামাজিক সংকট

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে বড় পতন

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে বড় পতন

ঢাকায় হংস মাংসের প্রথম ফ্যামিলি ক্যাফে

ঢাকায় হংস মাংসের প্রথম ফ্যামিলি ক্যাফে

স্টেশনে ঢুকে মেট্রোরেলে না চড়ে বেরিয়ে গেলে দিতে হবে ১০০ টাকা

স্টেশনে ঢুকে মেট্রোরেলে না চড়ে বেরিয়ে গেলে দিতে হবে ১০০ টাকা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App