×

মুক্তচিন্তা

একটি নতুন সংস্কৃতির আহ্বান

যদি রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের করণীয় কী?

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:২৪ পিএম

যদি রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের করণীয় কী?

যদি রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের করণীয় কী?

রাষ্ট্র যখন দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, নাগরিক সমস্যাকে অবহেলা করে কিংবা পথভ্রষ্ট ও অযোগ্য রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে ব্যর্থ হয়, তখন নাগরিকের কাজ কেবল রাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে থেমে থাকা নয়; বরং দেশের জন্য নিজে কিছু করা। রাষ্ট্রের ব্যর্থতা মানেই দেশের ব্যর্থতা নয়। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—যদি জনগণ চায়, তারা রাষ্ট্রকে বদলে দিতে পারে, এমনকি নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলতেও পারে।

আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে মানুষ রাষ্ট্রকে দোষারোপ না করে বরং নিজের অবস্থান থেকে দেশের জন্য দায়িত্ব নিতে শিখবে। এটাই নাগরিক শক্তির প্রকৃত পরিচয়, এবং এই শক্তিই পরিবর্তনের আসল চাবিকাঠি।

আমাদের ইতিহাসই এর সবচেয়ে বড় সাক্ষী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বা ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান

—কোনোটিই রাষ্ট্র বা সরকারের উদ্যোগে হয়নি, বরং জনগণের অদম্য শক্তিতেই সম্ভব হয়েছিল। তখনকার রাষ্ট্র ছিল ব্যর্থ, নিপীড়ন আর দমননীতি ছাড়া তাদের কাছে কিছু ছিল না। কিন্তু জনগণের শক্তি, নাগরিক দায়বদ্ধতা এবং দেশপ্রেম একত্র হয়ে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এই শিক্ষা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আমরা একই শিক্ষা পাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তারা সরকারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নাগরিকদের শৃঙ্খলা, কর্মনিষ্ঠা আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে দাঁড় করিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়াও ১৯৬০-এর দশকে ছিল ভয়াবহ দারিদ্র্যে জর্জরিত। অথচ আজ তারা উন্নত বিশ্বের শীর্ষে। এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল জনগণের সমবেত দায়বদ্ধতা ও স্বেচ্ছাশ্রম। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে রাষ্ট্র আর জনগণের সম্পর্কের ভিত্তি হলো আস্থা ও দায়িত্বশীলতা। জনগণ কর দেয়, নিয়ম মেনে চলে, একে অপরকে সহায়তা করে এবং সমাজের উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়, সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর হয়, এবং উন্নয়ন টেকসই হয়।

আমি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি। সুইডেনে চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমি সিস্টেমের ভেতরে থেকে দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করেছি। সেই দায়বদ্ধতা থেকে যা করেছি, তা আমাকে সমাজে দৃঢ় অবস্থান দিয়েছে। এখনো আমি চেষ্টা করি, কীভাবে সুইডিশ সমাজে নতুন কিছু শেখানো যায়—বিশেষ করে ইন্টিগ্রেশনকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছি।

এই কাজটি করতে কেউ আমাকে বলেনি, কোনো প্রতিষ্ঠান চাপ দেয়নি। আমি নিজ থেকে শুরু করেছি এবং কয়েক বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছি। এটি আমার দায়িত্ববোধ থেকে করা, যা আমি দেশের প্রতিও প্রয়োগ করতে চাই। প্রশ্ন হলো—আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের জায়গা থেকে দায়িত্ব নিই, যদি ছোট উদ্যোগগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসি, তবে কি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে বদলানো সম্ভব নয়? এইই হচ্ছে নাগরিক দায়বদ্ধতার মূল ভাবনা, যা নতুন প্রজন্মকে দেশ গড়ার পথে অনুপ্রাণিত করবে।

আসলে সংস্কৃতি মানে শুধু গান, নাচ বা ঐতিহ্য নয়; সংস্কৃতি মানে মানসিকতা। আমরা যদি ছোটবেলা থেকে পরিবার ও শিক্ষায় এই মানসিকতা শেখাতে পারি যে—“দেশ মানে শুধু রাষ্ট্র নয়, আমিও দেশ”—তাহলে প্রজন্ম নতুনভাবে বেড়ে উঠবে। এই শিক্ষাই ভবিষ্যতে তাদের সৎ, দায়িত্বশীল ও উদ্ভাবনী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।

আমরা প্রায়ই দেখি বিদেশে গিয়ে মানুষ বদলে যায়। কেন বদলায়? কারণ ওখানে দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সুইডেন, জার্মানি বা আমেরিকায় কেউ রাস্তায় আবর্জনা ফেলে না, ট্যাক্স ফাঁকি দিতে ভয় পায়, নিয়ম ভাঙলে শাস্তি পায়। অথচ সেই একই মানুষ দেশে ফিরেই নিয়ম ভাঙে। এর মানে হলো—আমাদের ভেতরে দায়িত্ববোধের বীজ আছে, শুধু সঠিক পরিবেশ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশে আমরা প্রায়শই এর উল্টোটা দেখি। আমরা রাষ্ট্রের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যসেবা—সবকিছু সরকারের দায়িত্ব বলে মনে করি। যখন সরকার ব্যর্থ হয়, তখন আমরা কেবল হতাশা, ক্ষোভ আর অভিযোগে ভরে উঠি। এর ফলে তৈরি হয় দুর্নীতি, অবহেলা, পলায়ন আর বিদেশমুখী মেধাপাচার। অথচ ছোট ছোট নাগরিক উদ্যোগও বড় পরিবর্তন আনতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় একটি গ্রামের কিছু তরুণ স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা মেরামত করছে, কেউ আবার নিজেদের চাঁদা তুলে একটি স্কুল গড়ে তুলছে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, নাগরিক চেতনা জেগে উঠলেই রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব। ছোট উদ্যোগ থেকেই বড় সংস্কৃতি জন্মায়, এবং প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ববোধের সঞ্চয় একদিন দেশের সমৃদ্ধিতে রূপান্তরিত হয়।

এই সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে। একজন যদি রাস্তার পাশে একটি গাছ লাগায়, আরেকজন যদি সৎভাবে ট্যাক্স দেয়, অন্যজন যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়—তাহলেই আস্তে আস্তে একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়। বড় পরিবর্তন কখনো একদিনে আসে না, আসে প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজের সঞ্চয়ে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র যদি ব্যর্থও হয়, জনগণ যদি দৃঢ় থাকে তবে রাষ্ট্র একসময় বাধ্য হয় বদলাতে। আমরা যদি কেবল অভিযোগ করি যে সরকার কিছু করছে না, তবে সমাধান আসবে না। আমাদের দাবি ও প্রয়াসের শক্তিই রাষ্ট্রকে পথে আনে। তাই জনগণের করণীয় হলো নিজের জায়গা থেকে শুরু করা, ছোট দায়িত্বকে বড় দায়িত্বে রূপান্তরিত করা।

আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য এ বার্তাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি নিজেদের ভেতরে সৎ, দায়িত্বশীল ও উদ্ভাবনী হওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে, তবে একদিন রাষ্ট্রও বাধ্য হবে সেই পথ ধরতে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে সেই প্রজন্মের হাত ধরে, যারা কেবল সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, বরং নিজেরাই দেশ গড়ার যাত্রায় নেতৃত্ব দেবে।

অতএব আজ প্রয়োজন এক নতুন সংস্কৃতি—যেখানে দায়িত্ব, সততা ও দেশপ্রেম হবে নাগরিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি। যখন মানুষ এ সংস্কৃতি নিজের ভেতরে ধারণ করবে, তখন আর অভিযোগ নয়, কাজই হবে আমাদের পরিচয়। রাষ্ট্র ব্যর্থ হলেও দেশ ব্যর্থ হবে না—যদি জনগণ দায়িত্ব নেয়। এই সংস্কৃতি যদি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়, তবে তা হবে এক নতুন মাইলফলক, যা শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নয়, সমগ্র জাতিকে এক নতুন পথ দেখাবে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন), [email protected]


সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো বাড়লো

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো বাড়লো

জুলাই হত্যাকাণ্ড: দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন সাবেক আইজিপি মামুন

জুলাই হত্যাকাণ্ড: দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন সাবেক আইজিপি মামুন

নুরুল হক নূরকে বিদেশে পাঠানোর নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

নুরুল হক নূরকে বিদেশে পাঠানোর নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের ইস্যুতে যা বললেন শাহেদুল আজম

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের ইস্যুতে যা বললেন শাহেদুল আজম

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App