শিশুর স্বপ্নের হাসিতে আলোকিত বাংলাদেশ

ড. মো. মঞ্জুরে মওলা
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪০ পিএম

শিশুর স্বপ্নের হাসিতে আলোকিত বাংলাদেশ
শিশু শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক নির্মল আনন্দ ও অপরিসীম সম্ভাবনা। শিশুরা নিষ্পাপ, কল্পনাপ্রবণ এবং সাহসে ভরপুর। তাদের স্বপ্নের হাসিতেই গড়ে উঠতে পারে আলোকিত বাংলাদেশ। আর সেই আলোকিত বাংলাদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন শিশু ও শিক্ষা-বান্ধব পরিবেশ।
উন্নত বিশ্বের নর্ডিক দেশগুলো এ বিষয়ে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা ১৮শ শতকের ফরাসি দার্শনিক জঁ-জাক রুশো এবং জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মতাদর্শ অনুসরণ করে শিশু অধিকার সনদকে অনুসমর্থন করেছে এবং তৈরি করেছে শিক্ষা-বান্ধব পরিবেশ। অথচ বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদকে প্রথম সমর্থনকারী ২২ দেশের একটি হলেও আজও সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ পুরোপুরি প্রতীয়মান নয়।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর মতে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিশুদের প্রতি অবহেলা কিছুটা বেশি। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বখ্যাত ফুটবলার জিনেদিন জিদানের উক্তি স্মরণযোগ্য— “খেলোয়াড় সৃষ্টি হয় না, খেলোয়াড়কে গড়ে তুলতে হয়।” একইসঙ্গে নাম না জানা কবির সেই পঙক্তিও প্রাসঙ্গিক “আমরা জীবন্ত খেলনার বীজ বপনে অভ্যস্ত, পরিচর্যায় নয়।” অর্থাৎ শিশুদের সঠিক পরিচর্যা ও অভিভাবকত্ব ছাড়া তারা কখনো আলোকিত নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে না।
ইতিহাস বলছে, শিশুদের আদর্শ অভিভাবক হতে পারে শিক্ষক। চীনের প্রাচীন দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন— “শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস, শিশুদের জন্য হবেন আদর্শ শাসক।” কিন্তু যখন শিক্ষক তার মৌলিক দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যস্ত থাকেন, তখন “শিশুর স্বপ্নের হাসি” ম্লান হয়ে যায়।
আজকের পৃথিবীতে শিশুদের বড় একটি অংশ বেড়ে উঠছে অনিশ্চিত পরিবেশে—খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষার অভাব, চিকিৎসার অপ্রতুলতা এবং সামাজিক বৈষম্যের ভেতর দিয়ে। তারা প্রতিনিয়ত খুঁজছে—
• স্নেহ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তা,
• ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য,
• দেহ ঢাকার জন্য পোশাক,
• পড়াশোনার জন্য বিনামূল্যের পাঠশালা,
• সুস্থতার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়।
এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প বলেছিলেন— “প্রতিটি শিশু একই স্বপ্ন দেখে—ভালোবাসা, সম্ভাবনা এবং বিপদ থেকে নিরাপত্তা।”
বিশ্বের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং ফিলানথ্রপিক সংগঠন ইতোমধ্যে শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বখ্যাত ফুটবলার লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. জুবাইদা রহমানসহ অনেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহায়তায় কাজ করছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো ‘একটি পরিবারমুখী কল্যাণমূলক সামাজিক নীতি’ (EPOCSAN) প্রণয়ন। এ ধরনের নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মূলধারার শিশুদের মতো সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হবে। শিশুদের জন্য শিক্ষা-বান্ধব পরিবেশ তৈরি হলে তবেই আমরা দেখতে পাবো—“শিশুর স্বপ্নের হাসিতে আলোকিত বাংলাদেশ”।
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার অভিজ্ঞতা বলে দেয়, রাষ্ট্র যদি প্রগতি, জ্ঞান, উন্নত ও নান্দনিক জীবনযাত্রার দিকে মনোযোগ দেয়, তবে আগামী দিনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠবে শিশু ও শিক্ষা-বান্ধব পরিবেশ। আর এই পরিবেশই নিশ্চিত করবে আলোকিত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশের মানুষ আজ একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে—“আমাদের শিশুদের অনাবিল হাসি দেখতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?” এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রের সঠিক নীতি, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ভেতরেই নিহিত।
লেখক: ড. মো. মঞ্জুরে মওলা, সমাজবিজ্ঞানী, টেকসই রিনিউয়েবল এনার্জি ও সার্কুলার অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, ফিনল্যান্ড