×

মুক্তচিন্তা

কপ৩০-এর ৫ম দিন

জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি ও কর্পোরেট প্রভাব লক্ষণীয়

Icon

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৪২ এএম

জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি ও কর্পোরেট প্রভাব লক্ষণীয়

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। ফাইল ছবি

বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ বছর সম্মেলনে ১,৬০০ জনেরও বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট অংশ নিচ্ছেন। এতে আয়োজক দেশ ব্রাজিল বাদ দিলে অন্য সব দেশের প্রতিনিধিদলের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

কিক বিগ পলিউটার্স আউট (কেবিপিও) জোটের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী প্রতি ২৫ জনের একজন জীবাশ্ম জ্বালানি সংশ্লিষ্ট লবিস্ট। এই সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি এবং ২০২১ সালে তথ্য বিশ্লেষণ শুরু হওয়ার পর সর্বোচ্চ। গত পাঁচ বছরে কপ সম্মেলনগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টের উপস্থিতি ৭,০০০–এ পৌঁছানোয় কর্পোরেট প্রভাব, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এবং তেল–গ্যাস শিল্পের বিপুল মুনাফার মধ্যে জলবায়ু আলোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ আরো বেড়েছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্রের (সিআইইএল) মানবাধিকার–বিষয়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট লিয়েন ভ্যান্ডামে একে জলবায়ু শাসন নয়, বরং কর্পোরেট দখল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ঘিরেও বেলেমে জটিল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। একদিকে ইইউ আলোচকরা বৈশ্বিক জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন, অন্যদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নিজস্ব জলবায়ু নীতি শিথিল করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০৪০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৯০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিদেশি কার্বন ক্রেডিট ব্যবহারের অনুমতি রাখা হয়েছে,যা বিজ্ঞানীদের সুপারিশের তুলনায় দুর্বল। একই দিনে সংসদ সদস্যরা বন উজাড় রোধে সরবরাহশৃঙ্খল আইন শিথিল এবং কর্পোরেট সবুজ নীতির পরিধি সংকুচিত করার প্রস্তাবও সমর্থন করেন। প্রতিযোগিতামূলকতার অজুহাতে গত দুই বছর ধরে ইইউ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নীতিগুলো সরলীকরণ করছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধে বৈশ্বিক চুক্তির দাবি আরো জোরালো করেছে। ইতোমধ্যে ১৭টি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি চুক্তিকে সমর্থন দিয়েছে। জলবায়ু কর্মীরা ব্রাজিলের কপ৩০ সভাপতিত্বকে দ্রুততর জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের পক্ষে শক্ত বার্তা দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। যদিও কপ২৮–এ দেশগুলো এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বাস্তবে অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর।

ট্রাম্প প্রশাসনের জলবায়ু কূটনীতি থেকে সরে যাওয়ার নীতিকে প্যারিস চুক্তির স্থপতি ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেস ছোট বাচ্চাদের আচরণের মতো বলে আখ্যায়িত করেছেন। ন্যান্সি পেলোসি কপ৩০–এ মার্কিন অনুপস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করে রিপাবলিকানদের দায়ী করেছেন। তার অভিযোগ, কংগ্রেসের অচলাবস্থা ছাড়াও ব্রাজিলে দ্বিদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠাতে রিপাবলিকানদের অনীহাই আমেরিকার অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ। ট্রাম্প প্রশাসন শুধু জলবায়ু কূটনীতি থেকে সরে যায়নি, বরং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চেও দূষণ মোকাবেলায় উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে।

কপ৩০ এর একটি বড় বিতর্ক লিঙ্গ শব্দের সংজ্ঞা ঘিরে। নারী অধিকারকর্মী ও বহু দেশ মনে করছে, লিঙ্গ শব্দটি সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের স্বীকৃত ভাষাকে পশ্চাৎমুখী করবে এবং আলোচনা ব্যাহত করবে। দেশগুলোর লক্ষ্য একটি নতুন লিঙ্গ কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ, যা জলবায়ু নীতিতে নারীর অভিজ্ঞতা ও লিঙ্গসমতা অন্তর্ভুক্ত করবে। ইইউ, নরওয়ে ও কানাডা ইন্টারসেকশনাল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে, বিপরীতে আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, রাশিয়া ও ইরানসহ কয়েকটি দেশ এর বিরোধিতা করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩ কোটি ৬০ লাখ নারী ও মেয়েকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছালেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে বেশিরভাগ দেশই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার জানাচ্ছে, কপ৩০–এর জন্য জমা দেওয়া নতুন এনডিসিগুলোও বিশ্বকে ২.৬°C উষ্ণায়নের পথে রাখছে। এটি প্যারিস চুক্তির সীমাকে স্পষ্টভাবে অতিক্রম করছে। মাত্র ১০০টি দেশ তাদের এনডিসি হালনাগাদ করেছে। গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্ট বলছে, ২০২৫ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমন আরো ১ শতাংশ বাড়তে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার দ্রুত হলেও তা বৈশ্বিক জ্বালানি চাহিদার বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ইতোমধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক–শিল্পযুগের তুলনায় ১.৩°C বেড়েছে—যার ফলে দুর্যোগ, দাবানল ও চরম আবহাওয়া আরো তীব্র হচ্ছে।

এ বছর কপ৩০–এ বেলেম হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান উদ্বোধন করা হয়েছে—এটি বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য–কেন্দ্রিক জলবায়ু অভিযোজন কাঠামো। এতে ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ, নীতি নির্ধারণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তির উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। একটি সাইড ইভেন্টে বক্তারা জানান, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে মানবজীবনকে গভীর ঝুঁকিতে ফেলছে। প্রাথমিকভাবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ ফান্ডার্স কোলিশন। বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের প্রয়োজন ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য অভিযোজন তহবিল অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের আরেক আলোচনায় সুন্দরবন ও হাকালুকি হাওরকে উদাহরণ দেখিয়ে স্থানীয় নেতৃত্বাধীন প্রকৃতি–ভিত্তিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। বক্তারা বলেন, বিজ্ঞান, স্থানীয় জ্ঞান ও নীতি একত্রিত হলে ইকোসিস্টেম–ভিত্তিক অভিযোজন সম্প্রসারণ সম্ভব।

কপ৩০–এর পঞ্চম দিন অতিক্রমেও বৈশ্বিক জলবায়ু নেতৃত্ব ও নীতি এখনও ধীর, বিভক্ত ও অনিশ্চিত। জীবাশ্ম লবিস্টদের প্রভাব, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, নীতি–পিছুটান এবং লিঙ্গ সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের কারণে বাস্তবায়ন আরো পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১.৫°C সীমার মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা রাখতে হলে এখনই দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ন্যায্য অর্থায়ন, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত অত্যাবশ্যক। কপ৩০ বিশ্ব নেতাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে—সময় দ্রুত ফুরোচ্ছে, এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার শেষ সুযোগ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

শততম টেস্টে বিশেষ সম্মাননা পাচ্ছেন মুশফিক

শততম টেস্টে বিশেষ সম্মাননা পাচ্ছেন মুশফিক

গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি পেলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান

গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি পেলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান

নতুন দাম্পত্য শুরু করলেন অমিতাভ-মুশফিকা

নতুন দাম্পত্য শুরু করলেন অমিতাভ-মুশফিকা

জম্মু ও কাশ্মিরে থানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত ৭

জম্মু ও কাশ্মিরে থানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত ৭

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App