কপ৩০ সম্মেলনের ৭ম দিন
জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ ও আমাজন রক্ষার দাবি
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫০ এএম
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। ফাইল ছবি
ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০-এ হাজারো কূটনীতিক, পরিবশকর্মী, সাংবাদিক ও লবিস্টরা সমবেত হলেও আলোচনাটি আবারও লবিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এবং বিভ্রান্তি ও আমলাতন্ত্রে ডুবে গিয়ে জলবায়ু সংকট মোকাবেলার লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতি ব্যাহত করতে পারে। গত বছরের কপ২৯-এর ফলাফলকে স্বল্পোন্নত দেশগুলো “বিস্ময়কর বিশ্বাসঘাতকতা” বলে অভিহিত করে।
সমালোচকদের মতে, দুর্বল দেশগুলোর সম্মিলিত প্রতিনিধিদলের চেয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের বিপুল উপস্থিতি, সম্মেলনটির লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতিকে স্তিমিত এবং আস্থাহীন করে দিতে পারে। যদিও কপ সম্মেলন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ক্ষয়ক্ষতির তহবিল এবং জলবায়ু অর্থায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক নীতিগতভাবে অর্জন করেছে, তা সত্ত্বেও এটি ধীর অগ্রগতি, অদক্ষ এবং বৈশ্বিক বৈষম্য মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে যেসকল মানুষদের জীবনে জলবায়ুর প্রভাব সবচেয়ে গভীর ও নেতিবাচক, তাদের কণ্ঠই আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা টানা দুই বছর ধরে প্যারিস চুক্তির ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা অতিক্রম করায় জাতিসংঘ সতর্ক করছে যে, এটি আমাজন বন শুকিয়ে যাওয়া বা গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে যাওয়ার মতো অপরিবর্তনীয় টিপিং পয়েন্ট তৈরি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, দ্রুত উষ্ণায়ন ঠেকাতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মিথেন নির্গমন হ্রাস। এই গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড–এর তুলনায় প্রায় ৮০ গুণ বেশি উষ্ণায়ন ঘটায়। মিথেন নির্গমন কমালে আগামী দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা শূণ্য দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূণ্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো সম্ভব। গবেষণা বলছে, উল্লেখযোগ্য মিথেন নির্গমন হ্রাস জলবায়ু পরিবর্তনের টিপিং পয়েন্ট বিলম্বিত করতে পারে এবং বড় অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনতে পারে। কিন্তু অনেক দেশ বিশেষত চীন, ভারত, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাদের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে না। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু বিপর্যয় রোধে মিথেন নির্গমন হ্রাস এখন সবচেয়ে জরুরি ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হতে পারে।
শনিবার বেলামের রাস্তাগুলোতে জলবায়ু ও প্রকৃতি সংকটের বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে আদিবাসীদের স্লোগান, ব্রাজিলিয়ান ধ্রুপদী গান এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচারের আহ্বানে হাজার হাজার মানুষের মিছিলের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু কর্মীরা কপ৩০-এর আমাজনীয় আয়োজক শহর বেলেমে একত্রিত হয়েছেন। গ্লাসগোতে কপ২৬-এর পর বেলেমের কপ৩০-এ এবারই প্রথম বড় উন্মুক্ত বিক্ষোভ দেখা গেছে। কারণ বিগত তিনটি সম্মেলন মিশর, দুবাই এবং আজারবাইজান মত স্থানে হয়েছিল যেখানে প্রকাশ্য প্রতিবাদের সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। চলমান “গ্রেট পিপলস মার্চ” বিতর্কিত আলোচনার মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে তাপাজোস অঞ্চলের আদিবাসী কর্মীদের নেতৃত্বে আরো দুটি বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তায় হাজারো মানুষের দাবি ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ, অ্যামাজনে খনন থামানো এবং আদিবাসী ভূমির অধিকার স্বীকৃতি। ব্রাজিলের আদিবাসী মন্ত্রী সোনিয়া গুজাজারা “আসল ব্লু জোন রাস্তায়” বলে কপ৩০-এর বন্ধ দরজার সমালোচনায় আগুন জ্বালেন। বিক্ষোভে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, তরুণ ও পরিবেশকর্মীরা একত্রে জানাচ্ছেন “উন্নয়ন নয়, অস্তিত্বই তাদের মূল লড়াই”।
আলোচনার এখনো এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও ক৩০ সম্মেলনে চূড়ান্ত ফল কী হবে তা স্পষ্ট নয়। ব্রাজিল জানিয়েছে, তারা এবার কোনো “কভার ডিসিশন” প্রকাশ করবে না বরং বাস্তবায়নকে প্রধান্য দেবে, যদিও এটি কীভাবে উপস্থাপিত হবে তা এখনও অনিশ্চিত। অপরদিকে, আলোচনায় অংশ নেয়া দেশগুলো আটকে আছে তথাকথিত “চারটি বড়” বিষয়ের ওপর: জলবায়ু অর্থায়ন, বাণিজ্য, স্বচ্ছতা এবং সম্প্রতি জমা দেওয়া অনেক দেশের জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনার সুস্পষ্ট অপ্রতুলতা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে। এসব বিষয়ই বর্তমানে “রাষ্ট্রপতির পরামর্শ” নামে একটি পৃথক আলোচনাসেটের অংশ হিসেবে উঠে এসেছে।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি আরামকো তেল বিক্রির মাধ্যমে প্রতিমিনিটে বিপুল অর্থ আয় করে। এই অর্থ দেশটির শাসকব্যবস্থা, জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি, বিলাসবহুল নির্মাণ প্রকল্প এবং আন্তর্জাতিক সফট-পাওয়ার উদ্যোগগুলোকে টিকিয়ে রাখে। ঠিক এই বিশাল তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতার কারণেই বৈশ্বিক জলবায়ু পদক্ষেপ, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা সৌদি আরবের অর্থনীতি ও শাসক পরিবারের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখা হয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সৌদি আরব জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনায় সবচেয়ে প্রভাবশালী বাধা-সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে কাজ করেছে। তারা আলোচনার এজেন্ডা পরিবর্তন, ম্যান্ডেট নিয়ে বিতর্ক, ঐকমত্যের নিয়মকে নিজেদের সুবিধায় ব্যবহার, এবং ধীরগতির সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করার মতো কৌশল ব্যবহার করে আসছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর অগ্রগতি বারবার বিলম্বিত হয়েছে। জলবায়ু সম্পর্কিত আলোচনার বাইরেও সৌদি আরব প্লাস্টিক উৎপাদন সীমিত করার বৈশ্বিক প্রস্তাব, জাহাজ চলাচলে কার্বন কর আরোপের পরিকল্পনা এবং মরুকরণবিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলনে জলবায়ু উল্লেখ ইত্যাদি উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে এবং ব্যর্থও হয়েছে।
সাম্প্রতিক জলবায়ু ও অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দেশটির বৈশ্বিক অবস্থানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। দেশটির বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি ৩৫ হাজার ২৩০ ডলার, যা বিশ্ব গড় ১৪ হাজার ২১০ ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবে পরিবেশগত দিক থেকে সৌদি আরবের দায়ও সমানভাবে বেশি। দেশটি বিশ্বের সপ্তম সর্বোচ্চ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ এবং প্রতিবছর ৭৩৬ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে। মাথাপিছু নির্গমনও অত্যন্ত উচ্চ প্রায় ২২ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন, যেখানে বৈশ্বিক মাথাপিছু গড় নির্গমন মাত্র ৪ দশমিক ৭ মেট্রিক টন। তাদের সর্বশেষ এনডিসি হালনাগাদ হয়েছে ২০২১ সালে। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণে দেশটির জলবায়ু পরিকল্পনাকে “অত্যন্ত অপর্যাপ্ত” হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রায় ৩৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
কপ৩০ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জ্যামাইকান অর্থনীতিবিদ মারিয়ামা উইলিয়ামস বলেন, আফ্রিকান মানুষ ঐতিহাসিক অবিচার, ঔপনিবেশিকতা ও দাসত্বের কারণে আজ জলবায়ু বিপর্যয়ের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভুক্তভোগী, তাই জলবায়ু ন্যায়বিচারকে ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায়বিচার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। উইলিয়ামস ও শতাধিক সংগঠনের মতে, শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার ভিত্তি ছিল উপনিবেশবাদ ও দাসত্ব থেকে সংগৃহীত সম্পদ, যার ফল আজও ক্যারিবিয়ানসহ বহু দেশে ঋণ, দুর্বলতা ও জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে বহমান। হারিকেন মেলিসার বিপর্যয় জ্যামাইকার দরিদ্র ও ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক মানুষকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যেটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের একটি বাস্তব উদাহরণ। যদিও আন্তর্জাতিক বীমা সহায়তা কিছু অর্থ দিচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষয়ক্ষতির জন্য জাতিসংঘ তহবিল অত্যন্ত অপর্যাপ্ত, এবং উচ্চ-নির্গমনকারী দেশগুলোকে ন্যায্য হিস্যা মেটাতে আরো বেশি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০-এ একদিকে আদিবাসী ও নাগরিক সমাজের তীব্র বিক্ষোভ, অন্যদিকে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যুবসমাজকে সামনে আনার বাংলাদেশের উদ্যোগ, এই দুটি প্রবাহই সম্মেলনের মূল আলোচনাকে ঘিরে চাপ সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে তরুণদের নেতৃত্বে লস অ্যান্ড ড্যামেজ কাঠামো নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানান, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে কেন্দ্রে না রাখলে পুরো কাঠামো অর্থহীন হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশ নিজস্ব লস অ্যান্ড ড্যামেজ কাঠামো তৈরি করছে, যেখানে তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
তরুণদের দাবি: সহজ প্রবেশাধিকার, স্বচ্ছতা, আগাম সতর্কতাভিত্তিক অর্থায়ন এবং স্থায়ী যুব প্রতিনিধিত্ব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান তহবিলের আকার অত্যন্ত কম এবং ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে কার্যকর কাঠামো দরকার। ব্রাজিল জোর দিয়ে বলছে, এই তহবিল শুধু অর্থ নয়, জলবায়ু সুবিচারের রাজনৈতিক স্বীকৃতি। সব মিলিয়ে কপ৩০-এর ভেতরের সিদ্ধান্তের মতোই রাস্তায় ওঠা দাবি ভবিষ্যৎ নথিতে প্রভাব ফেলবে কি না এখন সেদিকেই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
