আহমাদ স্বাধীন
বিনুদের বাড়িতে বুলবুলির বাসা

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিনুর বয়স আট বছর। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। পড়াশোনায় অতটা ভালো না। খেলাধুলায় ভালো। শুধু ভালো না, খুবই ভালো। সেই সঙ্গে দুষ্টমিতেও পাকা। বিনুদের বাড়ি লাগোয়া একটা মাঠ আছে। ছোট একটা মাঠ। রোজ সকাল-বিকাল বাচ্চারা খেলতে আসে।
বড়োরাও খেলে। তবে বাচ্চারাই বেশি। দিনের অর্ধেক সময় মাঠেই কাটায় বিনু। ওকে মেয়ে বলে কেউ আলাদা করে না। ছেলেদের সঙ্গে মিশেই খেলে বিনু।
এ জন্য রোজ মায়ের বকুনি খায়। তবে বাবার আগ্রহে খেলাধুলা চালিয়ে যায় বিনু। ওর বয়সে অন্যান্য বাচ্চারা যখন পুতুল খেলে সময় কাটায়, বিনু তখন ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডু নিয়ে ব্যস্ত। বাড়িতে ক্রিকেট খেলার চর্চা করে এ পর্যন্ত কয়েকবার সোকেস ও ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙেছে। প্রতিবার বাবা নতুন আয়না লাগিয়ে মায়ের বকুনি থেকে বাঁচিয়েছে বিনুকে।
বিনুদের বাসায় বেশ বড় একটা বারান্দা আছে। বারান্দাটা বিনুর খুবই পছন্দের জায়গা। এখানে দাঁড়িয়ে বিনু মাঝে মাঝে আকাশ দেখে। নানা রঙের মেঘ দেখে। আর দেখে উঁচু উঁচু সব অট্টালিকা। তার ফাঁকে ফাঁকে আছে কয়েকটা গাছ। কী গাছ তার নাম জানে না বিনু।
এক দিন দুপুরে মাঠ থেকে ফিরেই বিনু অবাক। বারান্দায় একটা পাখি বাসা বানিয়েছে। কবে থেকে এই বাসা তৈরি হলো বিনু জানে না। গত কয়েক দিন ও বারান্দায় আসেনি।
এই প্রথম এতটা কাছে থেকে বিনু একটা পাখির বাসা দেখছে, এটা কী পাখি? বিনু পাখি চেনে না। গাছ চেনে না। বিনু শহুরে মেয়ে। গ্রামের সঙ্গে ওর পরিচয় নেই। তাই পরিচয় হয়নি পাখি ও প্রকৃতির সঙ্গে। বিনু আনন্দে বাবাকে ডাকে।
বাবা নেই, তিনি ভোরেই অফিসে চলে যান।
বিনু মাকে ডাকে। মা ব্যস্ত ঘরের নানা কাজ নিয়ে।
বিনু বাবাকে ফোন করে। তাদের বাড়ির বারান্দায় একটা পাখি বাসা বানিয়েছে- এই আশ্চর্য ঘটনা বাবাকে এখনি জানাতে হবে।
বাবা অপর প্রান্তে বসে ফোন ধরে জানতে চান কী হয়েছে?
বিনু বলে, বাবা, একটা ভীষণ আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে! আমাদের বারান্দায় একটা পাখি বাসা বেঁধেছে। ও এখন থেকে আমাদের বারান্দায় থাকবে। কিন্তু আমি পাখিটাকে চিনি না, ওর নামও জানি না।
বিনুর কথা শুনে বাবা দ্বিগুণ উৎসাহে বলেন, তাই নাকি, খুবই আজব ঘটনা। আচ্ছা শোন, এখন তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বারান্দায় যাবে না। বাড়ির অন্যেরাও যেন না যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে। কোনোভাবেই যেন পাখিটা বিরক্ত না হয়। তাহলে কিন্তু চলে যাবে। আমি এসে দেখে তোমাকে বলব ওটা কী পাখি।
সেই থেকে বিনু বারান্দায় যায় না। কাউকে যেতেও দেয় না।
বাবা বাসায় ফেরেন বিকেলে। খুব সাবধানে আর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন বারান্দার পাখির বাসা। দেখে বিনুকে জানান, এটা বুলবুলি পাখির বাসা।
বিনু বলে, এই বুলবুলি পাখি এখন থেকে আমাদের অতিথি। আমরা ওর যতœ করব। যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখব।
বাবা বিনুর কথায় খুশি হন। বারান্দার নতুন অতিথিকে নিয়ে বাড়ির সবাই উৎসুক, সবাই বারান্দাটা পুরোপুরি ছেড়ে দেয় বুলবুলির জন্য। কেউ বিরক্ত করে না। বুলবুলির বাসায় দুইটা পাখি। বাবা বলেছেন, একটা মেয়ে পাখি আর একটা ছেলে পাখি।
বিনু খুব সাবধানে গিয়ে খোঁজ রাখে, ওদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। কিছুদিন যেতেই বিনু অবাক! বুলবুলির বাসায় ডিম। ডিম পেরেছে বুলবুলি পাখি। এই অবাক খবরটা বিনু বাবাকে ফোন করে জানায়।
শুনে বাবা খুশি হন আর বলেন, বুলবুলি পাখি আরো ডিম পারবে। তারপর সেই ডিম থেকে বুলবুলি পাখির ছানা হবে।
বিনু অধীর হয়ে অপেক্ষা করে সেই ছানা দেখার জন্য। সে এখন আগের চেয়ে কম মাঠে যায়। স্কুল থেকে ফেরার পর ব্যস্ত থাকে বুলবুলি পাখির বাসা নিয়ে। অদ্ভুতভাবে বুলবুলির সঙ্গে বিনুর বন্ধুতা হয়ে যায়। বিনুকে এখন আর আগের মতো সাবধানে যেতে হয় না। স্বাভাবিকভাবেই বিনু বুলবুলির বাসায় উঁকি দেয়। পাখিরা এখন দূরে উড়ে যায় না। কাছাকাছিই থাকে। ওরা যেন বুঝে গেছে, বিনু ওদের কোনো ক্ষতি করবে না। বুলবুলির বাসায় এখন পাঁচটা ডিম। এই ডিমের ওপর মা পাখিটা সারাক্ষণ বসে থাকে। বাবা পাখিটা যায় বাইরে খাবার আনার জন্য।
কেটে যায় আরো কিছুদিন। এক দিন সকালে বিনু অনেক বেশি অবাক হয়। বুলবুলি পাখির ছানা ফুটে বের হয় ডিম থেকে। সকালটা ছিল ছুটির সকাল। বাবার অফিস বন্ধ। তাই একটু দেরি করে উঠেন।
কিন্তু বিনু বাবাকে ঘুম থেকে প্রায় টেনে তুলে বলে, বাবা, আজ খুব বড়ো একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে।
বাবা জানতে চান, কী ঘটনা?
বিনু তাকে হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বলে, তুমি নিজেই দেখবে, আসো আমার সঙ্গে।
বাবা বারান্দায় গিয়ে দেখেন বুলবুলির ছানা।
বিনু বাবাকে বলে, এখন এই মা পাখিটা আমাকে ওদের বাসার কাছে যেতেই দেয় না। আগে যেতে দিত। এখন চেঁচামেচি করে।
বাবা বলেন, ওদের বাসায় নতুন ছানা হয়েছে। মা পাখিটা ভাবছে তুমি যদি ওর ছানার কোনো ক্ষতি করো, যদিও তুমি তা করবে না, সেটা আমি জানি। কিন্তু বুলবুলি তো জানে না। তুমি যখন ওই ছানাদের মতো ছোট ছিলে তখন তোমার মা তোমাকে সবার কাছে যেতে দেয়নি। ছানাদের নিয়ে সব মায়েরাই অনেক ভাবে। আর সব থেকে বেশি নিরাপদ রাখতে চায়।
বিনুর একটু মন খারাপ হয়। ছানাগুলোকে কাছে থেকে দেখার ইচ্ছা ছিল ওর। তা হলো না। না হোক। ওদের বারান্দায় এখন বুলবুলি পাখি ছানা নিয়ে বাস করছে। এটাই তো আনন্দের।
কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন থাকে না। বিনু সব থেকে বেশি অবাক হয় সেদিন সকালে, যেদিন দেখে বুলবুলির বাসায় ছানাগুলো নেই। ছানারা উড়ে গেছে! কোথায় গেছে, কেন গেছে, বিনু জানে না। বিকালে আবার বিনু বারান্দায় উঁকি দেয়। বুলবুলি ছানার মা-বাবাও নেই। সন্ধ্যা নাগাদ অপেক্ষা করে, পাখিরা ফিরে আসে না। মা-পাখি, বাবা-পাখি, ছানা-পাখি... কেউ না।
বিনু শুধু অবাকই হয় না, ওর কষ্ট হয়। ওরা তো কেউ পাখিদের বিরক্ত করেনি। তাহলে ওরা চলে গেল কেন?
বাবা বাড়ি ফিরলে বিনু বাবার কাছে যায়। ওর চোখে জল। বাবা বিনুকে কাছে টেনে নেয়। জানতে চায় কী হয়েছে। বিনু জানায় পাখিদের চলে যাওয়ার কথা- প্রথম ছানাগুলো উড়ে গেল, তারপর মা-বাবা পাখি দুটোও চলে গেল। কেন গেল বাবা? ওরা কি আমাদের ওপর রাগ করেছে?
বাবা বলেন, নারে মা, ওরা রাগ করে যায়নি। বুলবুলি পাখি দুটো চলে গেছে অন্য কোথাও নতুন করে বাসা বানাবে বলে। কারণ ওদের ছানারা চলে যাওয়ায় এখানে থাকতে ওদের মন খারাপ হয়। ছানারা উড়ে গেছে, কারণ ওদের ডানা গজিয়েছে, উড়তে শিখেছে। উড়তে শিখলে কেউ থাকে না। সবাই চলে যায়। ছানারা যতদিন ছোট থাকে, ততদিন বাবা-মার কাছে থাকে। বড় হলে সব কিছু নিজে নিজেই করতে শিখে যায়, তাই থাকে না। উড়ে চলে যায়। মা-বাবার থেকে দূরে চলে যায়।
বিনু কাঁদে বুলবুলি পাখির জন্য। বাবার চোখের কোণেও জল। গড়িয়ে পড়ছে না, চিকচিক করছে। বাবাদের চোখের জল সহজে গড়ায় না। কিন্তু ভেতরটা কাঁদে।
বিনুর দিকে তাকিয়ে বাবার ভেতরটা কাঁদছে।
বুলবুলি ছানার মতো বিনুও চলে যাবে এক দিন। যখন সে বড় হবে। বড় হলে কেউ কাছে থাকে না। দূরে চলে যায়।