ছাত্রদের ওপর গুলি
থানার সামনে দাঁড়িয়ে দম্ভ দেখালেন মামলার আসামি দেলোয়ার

মারুফ সরকার
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১০:১৫ পিএম

থানার সামনে দাঁড়িয়ে দম্ভ দেখালেন মামলার আসামি দেলোয়ার
যে ব্যক্তি জুলাইয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই মামলার সংশ্লিষ্ট রামপুরা থানার সামনে। যেন কোনো ভয় বা সংকোচ নেই—উল্টো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলে তা পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে ক্যাপশনে লিখেছেন—"রামপুরা থানার অফিসার ইনচার্জসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। অফিসার ইনচার্জ খুবই আন্তরিক ছিলেন, সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। তবে আমাকে যদি কেউ গ্রেপ্তার করে, তার চাকরি থাকবে না।"
ছবিটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর আলোচনায় উঠে আসে আরও বিস্ময়কর তথ্য। সূত্র বলছে, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু রামপুরা থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবকে জানান—‘উপরের নির্দেশনা রয়েছে, এখন গ্রেপ্তার করা যাবে না।’
শুধু ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর দায় নয় দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। জবরদখল, প্রতারণা, চাঁদাবাজি, এমনকি এসি বিস্ফোরণের মতো প্রাণঘাতী ব্যবসা সিন্ডিকেটেও তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ভুয়া পরিচয়ে নিজেকে আন্দোলনে আহত যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরে সরকারের কাছ থেকে সুবিধাও নিয়েছেন।
এই বিষয়ে থানার ওসি মোহাম্মাদ রাহাৎ খান বলেন, “আমি দেলোয়ারের থানায় আসা কিংবা ছবি তোলার বিষয়ে কিছুই জানি না। র্যাবকে গ্রেপ্তার করতে বাধা দেয়ার কথাও আমার জানা নেই। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
রাজনৈতিকভাবে দেলোয়ারের ঘনিষ্ঠতা ছিল ঢাকার সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার সঙ্গে। ঢাকা-১৬ আসনে তার সঙ্গে বিরোধ ছিল মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার মো. মান্নান কচির। অভিযোগ রয়েছে, কচি আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় ইলিয়াস মোল্লা নিজে ‘কৃতিত্ব’ নিতে মাঠে নামেন এবং দেলোয়ারকে রামপুরায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে নির্দেশ দেন।
দেলোয়ারের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। পিতা আব্দুর রহমান ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী শ্রমিক লীগের এক নেতা। আগে সাভারে বসবাস করতেন দেলোয়ার, সেখান থেকেই আন্দোলন দমনকারী হিসেবে মাঠে নামেন। আহত হওয়ার পর নিজের পরিচয় পাল্টে আন্দোলনকারীর মুখোশ পরেন। এরপর ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, দেলোয়ার এসি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ব্রামার এক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। নিম্নমানের কুলিং গ্যাস আমদানি করে তা বাজারে ছাড়েন আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে। এসব গ্যাসে বিস্ফোরণ হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হলেও তদন্ত হয়নি। এই সিন্ডিকেটকে ছায়া দিয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, ইলিয়াস মোল্লা ও পঙ্কজ দেবনাথ।
একাধিক ফোনালাপে দেলোয়ার বিএনপি-জামাতকে “লাত্থায়ে-উষ্টায়ে” তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। এক রেকর্ডে বলেন, “আপনারা যদি আমাকে সহযোগিতা করতেন, আমি গণপিটুনি দিয়ে ওদের ঢাকায় থাকতে দিতাম না।”
আরেক ফোনালাপে রাজধানীতে হাজার হাজার এসি ফ্রিজ শ্রমিক জড়ো করার পরিকল্পনার বিষয়টি উঠে আসে। বিষয়টি ফাঁস হলে কর্মসূচি বাতিল করতে বাধ্য হন তিনি।
মিরপুরের ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, “আমি ঘটনার সময় কক্সবাজারে ছিলাম। এরপরও আমার নামে মামলা দেয় দেলোয়ার। পরে দেখা করে বলে, ৫ লাখ টাকা দিলে মামলা মিটমাট হয়ে যাবে।”
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, দেলোয়ার তার কাছ থেকেও মামলা তুলে নেয়ার নামে টাকা নিয়েছেন। একটি কল রেকর্ডে শোনা যায়, দেলোয়ার বলছেন, “খরচপত্র দিলেই নাম বাদ যাবে।”
কিশোরগঞ্জের নাসির উদ্দীন শাহিন নামে এক ব্যবসায়ীকে ভয় দেখানোর রেকর্ডও গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। সেখানে দেলোয়ার তাকে “বদমাইশি ছাড়ানোর” হুমকি দেন।
প্রতিবেশী জসিম উদ্দিন বলেন, “শুনি দেলোয়ার আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি করেন। কিন্তু সে ছাত্র আন্দোলন দমন করতেই মাঠে ছিল। আহতও হয়। এখন সে-ই আবার আন্দোলনের সমন্বয়ক! আর এখন মিথ্যা মামলা দিয়ে নাম বাদ দিতে টাকা দাবি করছে।”
দেলোয়ারের অতীত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একসময় কিশোরগঞ্জে ক্লিনারের কাজ করতেন। পরে ফ্যান-মোটর সারাই শিখে ঢাকায় এসে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
এই পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, “একজন আসামি জামিন ছাড়া থানার সামনে গিয়ে ছবি তুলে তা প্রকাশ করলে সেটা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার বড় দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। এতে অপরাধ বাড়বে, কমবে না।”
ডিএমপির মিডিয়া ও গণসংযোগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা ব্যক্তি যদি এজহারভুক্ত আসামি হোন এবং ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। থানার সামনে দাঁড়িয়ে দেলোয়ারের তোলা ছবি দিয়ে প্রতিবেদককে সহযোগিতাও করতে বলেন এই কর্মকর্তা।
সবশেষে দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,"আমি রামপুরা থানায় গিয়েছিলাম—জানতে চেয়েছিলাম, আমার নামে সত্যিই কোনো মামলা আছে কি না। ডিউটি অফিসার বিষয়টি যাচাই করে আমাকে জানান, মামলা রয়েছে। এরপর আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি এবং ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। আমি নিজেকে জুলাই যোদ্ধা পরিচয়ে পরিচয় দিই। পরে ওসি সাহেব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে আমার মামলাটি কীভাবে হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে বলেন।"
ইলিয়াস মোল্লার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা জানতে চাইলে দেলোয়ার বলেন, "ইলিয়াস মোল্লার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক ছিল না। সাংগঠনিক প্রয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে একবার দেখা হয়েছিল।"
তবে, ইলিয়াস মোল্লার সঙ্গে ব্যানার ও ফেস্টুনে তার নাম ও ছবি থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি দেলোয়ার।