নীরব ঘাতক, হাড়ক্ষয় রোগ
মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশই এ রোগে ভুগছে
সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:১৯ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
মাসখানেক যাবতই হাত ঝিমঝিম আর ঘাড় ব্যথায় ভুগছিলেন নিলিমা রায় (৩৮)। পেশায় সরকারি একটি কলেজের প্রভাষক। আর সহ্য করতে না পেরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা দিলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, তার ঘাড়ের হাড়ে ক্ষয় শুরু হয়েছে।
নিলিমা রায় বলেন, চিকিৎসক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি ঝোঁকে কোনো কাজ করি কিনা। আমি যেহেতু পেশায় একজন শিক্ষক আমাকে প্রায়ই পরীক্ষার খাতা দেখতে হয়। অনেক সময় বোর্ডের খাতাও দেখি। দীর্ঘসময় ধরে ঝোঁকে খাতা দেখা হয়। পরীক্ষার প্রশ্ন, সিলেবাস করার সময়ও কিছুটা ঝোঁকে কম্পিউটারে কাজ করতে হয়। এগুলো বলার পর চিকিৎসক বললেন- এ কারণেই সমস্যা হয়েছে। কিছু ওষুধ আর ঝোঁকে কাজ না করার নির্দেশ দিয়েছেন চিকিৎসক।
অঞ্জনা রহমান (৫২) একজন গৃহিণী। কোমড় ও ঘাড়ের ব্যথায় ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। বেশ কয়েবার চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খেয়েও খুব একটা উপকার পাননি। সর্বশেষ বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গিয়ে কোমড়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলেন। এরপরই ঢাকায় এসে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। এক্সরে, এমআরআই করে ধরা পড়ল অঞ্জনা রহমানের কোমড়ে এবং ঘাড়ের হাড়ক্ষয় রোগ। মেরুদণ্ডের একটু অংশ ফুলে টিউমারের মতো হয়ে গেছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশই হাড়ক্ষয় রোগে আক্রান্ত এবং এই রোগে নারীরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই রোগটির নাম অস্টিওপরোসিস। এই রোগে আক্রান্তদের অনেকেই তাদের রোগ সম্পর্কে জানেন না। ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৫০ থেকে ৭০ বয়সী যারা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই নারী। তবে ৭০ বছর থেকে শুরু করে পরের বয়সীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা কিছুটা বেশি।
এর আগে ২০২২ সালে সোসাইটি অব নিউরোস্পাইন বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৫০ লাখ মানুষ মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৫ লাখ মানুষ মেরুদণ্ডের গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত। প্রতি বছর দেশে প্রায় ২০ হাজার রোগীকে স্পাইনজনিত সমস্যার কারণে অপারেশন করতে হয়। এ সংখ্যা এখন অবশ্যই বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর ২০২৩ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মেরুদণ্ডের সমস্যার প্রধান কারণ আঘাত। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেরুদণ্ডের রোগীদের ৫৭ শতাংশই কোনো না কোনো আঘাত পাওয়া। সড়ক দুর্ঘটনার চেয়ে পড়ে গিয়ে বেশি মানুষ মেরুদণ্ডে আঘাত পান। দেশে এটি এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ১৮টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভোগা ২ হাজার ৪৬৯ জন রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে গবেষকেরা দেখেছেন, ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ রোগী কোনো না কোনো সময়ে আঘাত পেয়েছেন। ৪১ দশমিক ১ শতাংশের মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণ কোনো না কোনো রোগ। বাকি ১ দশমিক ৯ শতাংশ কডা ইকুইনা সিনড্রোমে (চাপে মেরুরজ্জুর ক্ষতি) ভোগে।
হাড় ক্ষয় রোগকে নীরব ঘাতক উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যখন সমস্যা দেখা দেয় তখন বুঝতে হবে যে সমস্যাটা একটা মাত্রায় পৌঁছে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় পৌঁছালে তা জটিল হয়ে পড়বে। রোগটি শুরুর দিকে ধরা পড়লে তা সামলে নেয়ার চিকিৎসা আছে। তারা আরো বলছেন, আগামী পাঁচ বছরে অসংক্রামক যেসব রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তার মধ্যে শীর্ষ পাঁচে এই হাড়ক্ষয় রোগ উঠে আসবে।
অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সালাম জানান, প্রতিটি মানুষের শরীরের হাড়ের একটি গঠন প্রক্রিয়া আছে। জন্মের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাড় নানাভাবে পরিপক্ব হতে থাকে। এরপর আবার একটা সময়ে এসে ঘনত্ব কমে হাড় পাতলা হতে শুরু করে। আর এই হাড়ের ঘনত্ব যখন কমে যায় তখনই সেটা একটা রোগ। আর এর নামই হচ্ছে হাড় ক্ষয় রোগ। হাড়ের স্ক্যান করে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন- এর ঘনত্ব কতটা কমেছে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। রোগটিতে আক্রান্ত হলে হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় ছিদ্রযুক্ত, দুর্বল এমনকি ভেঙেও যেতে পারে। সঠিক সময়ে এর প্রতিরোধ বা চিকিৎসা না নিলে একান্ত ব্যক্তিগত কাজ করাটাও জটিল হয়ে উঠে।
হাড়ক্ষয় রোগে পুরুষের চাইতে নারীরা কেন বেশি আক্রান্ত হন- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বয়স পর স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের হাড় ক্ষয় হতে থাকে। মানুষের শরীরের এ ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে হরমোনের প্রভাব থাকে। আর নারীদের শরীর থেকে হরমোন খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে এস্ট্রোজেন এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে মেয়েদের মাসিক বন্ধ হলে বা মেনোপোজের পর এটি বেশি হয়। আর হরমোন কমে গেলে শরীর থেকে দ্রুত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি বের হয়ে যায়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি কমে গেলে তখন শরীর আর হাড় গঠন করতে পারে না। ফলে শুরু হয় হাড়ক্ষয়। এছাড়া যারা ক্যানসার, রক্তরোগ, অপুষ্টি রোগ, কিডনি রোগে আক্রান্ত তাদের হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এর বাইরে নানা রোগের চিকিৎসার জন্য যারা দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড সেবন করে তাদের হাড়েরও ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় ক্ষয় রোগ হতে পারে।
এ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে বাংলাদেশ স্পাইন অ্যান্ড অর্থোপেডিক হাসপাতালের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. শাহ আলম বলেন, হাড় ক্ষয় একটি নীরব ঘাতক। অনেকেই বুঝতে পারেন না- তিনি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। সাধারণত মানুষ পিঠের ব্যথা নিয়েই আমাদের কাছে আসেন। এছাড়া কোমর ব্যথাও অনেকের মধ্যে দেখা যায়। পরে দেখা যায় তারা হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। এই লক্ষণগুলোই বেশি আগে ধরা পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত যতটুকু আঘাতে একজন ব্যক্তির হাড় ভাঙার কথা তার মাত্র এক পঞ্চমাংশ আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। আর মেরুদণ্ডের হাড়ের ক্ষয় হলে মানুষ একটা পর্যায়ে গিয়ে কুঁজো হয়ে যায়। মেরুদণ্ড ছাড়াও কোমর, হাতের কব্জি, পায়ের কুচকির হাড়ের ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা বেশি। যেসব হাড় মানুষের দেহের ওজন বহন করে সেগুলোই ক্ষয় হয় বা ভেঙে যায়।
হাড়ক্ষয় রোগের চিকিৎসা বা প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসার চেয়ে রোগটি প্রতিরোধ করাই মুখ্য এবং উত্তম। এজন্য ছোটবেলা থেকেই সুষম খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করা জরুরি। আর শারীরিক পরিশ্রম ও রোদে যাওয়াটাও সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি রোগ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর গুরুত্ব দেন তারা। পাশপাশি সতর্কতা হিসেবে বাসা বাড়িতে বাথরুমের পিচ্ছিল ভাব দূর করা, রাতে ঘরে মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখা এবং অন্ধকারে চলাফেরা না করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
