ভোগ্যপণ্যের বাজার
উচ্চমূল্যে ‘স্থিতিশীল’ মাছ, গরু-খাসির মাংসও অধরা
সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৩১ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
‘হয় সবজি, না হয় মাছ-মাংস, না হয় চাল, না হয় পেঁয়াজ-আদা-রসুন, না হয় সবজি-কাঁচা মরিচ; প্রতি সপ্তাহেই কিছু পণ্যের দাম বাড়তি থাকেই। এটাই যেন বাজারের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমিত আয় কিংবা গরিব মানুষের কষ্ট কেউই বোঝে না। বাজারে গিয়ে পছন্দ করতে হয় যে কোনো একটা সবজি। মাছ-মাংসের স্বাদ অনেকটাই ভুলতে বসেছি। আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলেন গোপীবাগ বাজারের ক্রেতা ফিরোজ মিয়া। তিনি পেশায় একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী।
ওই বাজারে ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে সামুদ্রিক চাপিলা। সেই মাছ বাড়ির পোষা বিড়ালের জন্য কিনছিলেন এক ক্রেতা। কথাটা জানতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই ক্রেতার পাশে দাঁড়িয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, গরিবের তেলাপিয়া, পাঙাশ কিংবা সামুদ্রিক চাপিলা মাছও এখন ধনী লোকের কব্জায়। আমাদের মতো সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের শুক্রবার বাজারে আসা উচিত নয়। ভ্যান কিংবা ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে এক পোয়া কিংবা আধা কেজি সবজি কিনে খাওয়াই ভালো।
ওই এলাকায় কয়েকটি ডিমের দোকানে বিক্রি হয় ফাটা বা ভাঙা ডিম। যেগুলো ভালো ডিমের দামের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা কম দামে পাওয়া যায়। ১২০ টাকা দিয়ে এক ডজন ভাঙা ডিম কিনলেন গৃহিণী হালিমা বেগম। তিনি বলেন, মাছ-মাংসের যে দাম তা আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের পক্ষে সব সময় খাওয়া সম্ভব হয় না। ৫ জনের সংসারে খরচও কম নয়। এই ডিমগুলো খারাপ না। ডিমতো ভেঙেই খেতে হবে। দামটাও কম। তাই কিনলাম। কিছু টাকা সাশ্রয়ও হলো।
বাজারে বাহারি সবজি, দামও কমেছে
শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত দুই/ তিন সপ্তাহ ধরেই বিভিন্ন সবজির দামে নিম্নমুখী ভাব। সবজির বাজারে দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে অসন্তোষ অনেকটাই কমেছে। শীতকালীন সবজির সরবরাহ ভালো থাকায় বাজারেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিম, বেগুন, করলা, ঢ্যাঁড়শ, পটোল, লাউ, বরবটি ও কাঁচা মরিচের দাম আগের তুলনায় অনেক কমেছে। দুই সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি শিমের দাম ছিল ২০০ থেকে ২২০ টাকা, এখন তা ৬০ থেকে ৮০ টাকায় নেমে এসেছে। বেগুনের দামও মানভেদে কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ১শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখনো সবচেয়ে কম দামের সবজির মধ্যে রয়েছে পেঁপে, যা প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি কেজি পটোল ৬০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, ঝিঙ্গা ৬০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা, ধন্দুল ৬০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৭০ থেকে ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, বাজারে নতুন ওঠা শালগম ১শ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বাঁধাকপি ও ফুলকপি প্রতি পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১৬০ টাকা, টমেটো ১২০ টাকা, আলু প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অনেক দিন পর মন ভরে সবজি বাজার করতে পেরেছেন বলে জানালেন হাতিরপুল বাজারের ক্রেতা মাসুম হোসেন। তিনি বলেন, সবজির দামটা কমেছে। মানুষ অনেক দিন পর মনভরে সবজি কিনতে পারছে। তবে হঠাৎ পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সবজিতে বেঁচে যাওয়া টাকাটা আবার খরচ হয়ে যাচ্ছে পেঁয়াজ কিনতে।
ঝাঁজ দ্বিগুণ হয়েছে পেঁয়াজের
সপ্তাহের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে পেঁয়াজের দামে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যপণ্যটির দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৪০ টাকা। গত সপ্তাহে ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকা দরে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য বলছে এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৫৮ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ চেইন ঠিক না থাকায় মজুত সংকটে পড়েছে পেঁয়াজের বাজার। অন্যান্য বছর যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হতো তা চলতি বছর হয়নি। বিদেশি আমদানিতে বাধা পড়ায় পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, পেঁয়াজের দাম বাড়লেও এ মাসেই নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসছে। তখন দাম কমে যাবে। শান্তিনগর বাজারের বিক্রেতা আলী হোসেন বলেন, চলতি মাসে নতুন পেঁয়াজের একটি বড় চালান বাজারে আসতে শুরু করবে, যা বাজারে পেঁয়াজের দামে ভ‚মিকা রাখবে। ফলে দাম কিছুটা বাড়লেও আর বাড়ার সুযোগ নেই।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দাম ঠিক কী কারণে বেড়েছে জানি না। আমরা বেশি দাম দিয়ে এনেছি। তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম বাড়ার পেছনে আমাদের কোনো হাত নেই। দাম বাড়ায় বিক্রি কমে গেছে, আবার ক্রেতাদেরও জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা অযাচিত পরিসংখ্যানে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভোক্তার চাহিদা ও জোগানে হিসেবে এই সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কিন্তু যে কোনো কারণে তা এবার হয়নি। এছাড়া দেশে উৎপাদন বাড়লেও পরবর্তী সংরক্ষণ বা আমদানি-আবশ্যকতা ঠিকমতো পূরণ হয়নি। যেমন প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ স্টোরেজ ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন।
মাছের বাজার স্থিতিশীল তবুও দাম চড়া : আর মাছের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও দাম এখনো চড়া। রুই, কাতল, পাঙাশ থেকে তেলাপিয়াÑ সব মাছই আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। বড় রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা, মাঝারি রুই ৩শ থেকে ৩২০ টাকা ও ছোট রুই ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি দরে। কাতল মাছের দাম ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, শিং মাছ ৫৫০ টাকা, মাগুর ৫শ টাকা, চাষের কৈ ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা, এবং তেলাপিয়া ১৫০ থেকে ২২০ টাকা, সিলকার্প মাছ ২৫০ থেকে ৩শ টাকা, বোয়াল মাছ ৫শ থেকে ৮শ টাকা, কালিবাউশ মাছ ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ ৬শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে ছোট চিংড়ি ৪শ টাকা, কাঁচকি মাছ ৪৫০ টাকা, মলা মাছ ৩শ টাকা, পাবদা মাছ আকারভেদে ৩শ থেকে ৬শ টাকা, গলদা চিংড়ি আকারভেদে ৬৫০ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
মাংসের বাজার এখনো নাগালের বাইরে : বাজারে মুরগি, গরু কিংবা খাসি- সব মাংসের দাম এখন লাগামহীন। তাই ইচ্ছা থাকলেও লাগামহীন বাজারে বেশি দাম হওয়ায় মাংস কেনার সামর্থ্য নেই নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের। কোনো কোনো পরিবার আগে প্রতি মাসে একবার গরুর মাংস কিনলেও এখন তা ৩/৪ মাস পর কিনছে। ঊর্ধ্বগতির বাজারে ব্রয়লারেই ভরসা রাখতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
রামপুরা বাজারে ক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে প্রতি মাসে একবার গরুর মাংস ও প্রতি সপ্তাহে একবার মুরগির মাংস খেতাম। এখন বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসার খরচ মিলে গরুর মাংস বাদ দিয়ে মাসে একবার মুরগির মাংস কিনে নেই। কমের মধ্যে ব্রয়লার মুরগিই রয়েছে। দেশি মুরগি তো এখন একেবারে নাগালের বাইরে। তাই বাধ্য হয়ে ব্রয়লার মুরগিই কিনতে হয়।
বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, লাল লেয়ার ৩শ টাকা, সোনালি মুরগি ২৮০ টাকা, পাকিস্তানি মুরগি ৩২০ টাকা ও দেশি মুরগি ৬শ টাকা কেজি দরে। আর দেশি হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬শ টাকায়। গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮শ টাকা, আর খাসির মাংস ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা ডজন।
মুরগি বিক্রেতা কাদের মিয়া বলেন, মুরগির বাজার এখন পুরোপুরি খামারনির্ভর। খাদ্যের দাম আর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা অনেক সময় পুরনো দামে বিক্রি করলেও পরে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হয়। মানুষ ভাবছে আমরা দাম বাড়াচ্ছি, আসলে আমরাও বিপাকে।
নিম্নমুখী চালের দাম
বাজারে কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে চালের দামে। কারণ আমনের ভরা মৌসুম শুরু হতে আর বাকি মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিন। এরই মধ্যে কোনো কোনো অঞ্চলে রোপা আমন ধান মাঠ থেকে উঠতে শুরু করেছে। পাশাপাশি কিছু চাল আমদানিও করা হচ্ছে। এই দুইয়ে মিলে চালের বাজারে স্বস্তির আভাস মিলছে বলে জানিয়েছেন খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, জিরা, পাইজাম, গুটি স্বর্ণাসহ কয়েক ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ১ থেকে ২ টাকা কমেছে। দাম এর আগের সপ্তাহেও ১ টাকা করে কমেছিল। সে হিসাবে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত কমেছে। এখন বাজারে শম্পা কাটারি কিংবা নাজিরশাইলের মতো ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা কেজি। এছাড়া জিরাশাইল, জিরা নাজির, মিনিকেটসহ বিভিন্ন জাতের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকায়। মোটা ধরনের ব্রি২৮ চালের দাম স্থির রয়েছে আগের মতোই কেজিপ্রতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়।
