মাথাচাড়া দিচ্ছে নির্মূলের পথে থাকা রোগব্যাধি

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:১৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
প্রায় নির্মূলের পথে থাকা রোগব্যাধিগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জলাতঙ্ক তেমনই একটি রোগ। চলতি বছর দেশে জলাতঙ্ক রোগী বাড়ছে। মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর কুকুরসহ প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে আসে সোয়া ৫ লাখ মানুষ। ওই বছর জলাতঙ্কের কারণে মারা যায় ৫৬ জন। চলতি বছর ৮ মাসে (আগস্ট মাস পর্যন্ত) জলাতঙ্কে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের।
জলাতঙ্ক রোগী ও মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মাঝে কুকুর-বিড়াল পালনের প্রবণতা বাড়ছে। তবে ঠিকমত টিকা দেয়া হচ্ছে না সেই প্রাণীদের। এছাড়া রাস্তাঘাটে কুকুরের সংখ্যা বাড়লেও জলাতঙ্ক রোধে কুকুরকে টিকা দেয়ার কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ। আবার আক্রান্ত মানুষকে দেয়ার সরকারি টিকার (র্যাবিক্স-ভিসি) সংকটও দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যের অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বন্ধ থাকায় চলমান কর্মসূচি ব্যাহত হয়েছে। ওপির কারণেই কালাজ্বর, গোদরোগ, জলাতঙ্কসহ এমন অনেক রোগ নির্মূল হয়েছে বা নির্মূলের পথে। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া ওপি বন্ধের কারণে কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। এতে করে দীর্ঘ দিনের অর্জন হুমকিতে পড়েছে। নীরবে রোগী বাড়ছে।
এদিকে জানা গেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের কাছে জলাতঙ্কের টিকার মজুত মে মাসেই শেষ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই রোগ প্রতিরোধে সরকারি টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের শিকার ব্যক্তিদের নিজের টাকায় টিকা কিনতে হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এশিয়া ও আফ্রিকাতে জলাতঙ্ক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এই রোগে মৃতদের ৪০ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের কম। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, জলাতঙ্কে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের জলাতঙ্ক-প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। রোগটির ৯৬ শতাংশের কারণ কুকুরের কামড়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানরসহ উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক রোগ হয়। জলাতঙ্ক রোগ জেনাস লাইসাভাইরাস অন্তর্ভুক্ত ১২টি স্বতন্ত্র প্রজাতির অন্যতম ভাইরাসজনিত ব্যাধি। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জুনোটিক প্রকৃতির এই রোগ মানুষ, প্রাণী উভয়ের মস্তিষ্ক-প্রদাহ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই রোগের ভয়াবহতা হলো, লক্ষণ দেখা দিলে এক সপ্তাহ বা দেড় সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু হয়। তবে, খরগোশ বা ইঁদুরের কামড়ে এ রোগ হতে দেখা যায় না।
জলাতঙ্ক রোগী ও মৃত্যু বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আরিফুল বাসার। রোগী বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, কুকুর বিড়ালসহ নানা ধরণের পশু পাখি পালনে মানুষের এখন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু তাদের ঠিকমত টিকা দেয় না। এ কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত জলাতঙ্কে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। টিকা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টিকার সংকট আছে। ৫ আগস্টের পর সব ধরনের ওপি বন্ধ হয়ে যায়।
জানা যায়, দেশে জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য ২০১০ সালে ‘জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি’ নেয় সরকার। ২০১১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি চালু করে। ওই বছরই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ যুক্ত হয়। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখা এই কর্মসূচি পরিচালনা করছে। সিডিসি বলছে, জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু শতভাগ হওয়ায় ২০১১ সালে বিনামূল্যে সারাদেশে টিকা দেয়া শুরু করা হয়। সিডিসি সরাসরি টিকা কিনত। বর্তমানে ওপি না থাকায় সরকারের বিশেষ বরাদ্দে টিকা কিনছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। গত ফেব্রুয়ারিতে সিএমএসডি ১ লাখ ৪ হাজার টিকা কেনে। মে মাসেই এই টিকার মজুত শেষ হবে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত ব্যক্তিকে তিন থেকে চার ডোজ র্যাবিস টিকা দিতে হয়। প্রাণীর আক্রমণে রক্তাক্ত আহতদের অতিরিক্ত হিসেবে র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) দেয়া হয়। এক ভায়াল টিকার দাম স্থানীয় বাজারে ৫’শ টাকা। আরআইজির দাম ১ হাজার টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে জলাতঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে।
জানা যায়, জলাতঙ্কে যে টিকা ব্যবহার করা হয় তা দেশে উৎপাদন হয় না। পপুলার এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস এই টিকা আমদানি করে। এক্ষেত্রে ইনসেপ্টার টিকার চাহিদা বেশি। গত এক দশক ধরে সেই টিকাই সরকার কিনছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন অনুযায়ী, দেশের অবহেলিত রোগগুলোর অন্যতম জলাতঙ্ক। এই আইনে শতভাগ মরণব্যাধি হওয়ার পরও জলাতঙ্ক আক্রান্ত মৃত ক্লিনিক্যাল রোগীর ময়নাতদন্ত করার বিধান সুস্পষ্ট করা হয়নি। অথচ দেশের বিদ্যমান সিস্টেমে বিষপান, আত্মহত্যা, হত্যাকাণ্ডের মতো অমানবিক ঘটনায় অহরহ ময়নাতদন্ত হয়। জলাতঙ্ক আক্রান্ত রোগীর ময়নাতদন্ত বলতে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ তে একটি উপযুক্ত ধারা/উপধারার সংযোজন করা। জলাতঙ্ক নির্মূল অগ্রযাত্রার (২০১১-২৪) সময়ে জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষে একটি কেসও ল্যাবরেটরি ডায়াগনোসিস হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও লাইন ডিরেক্টর (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যু অনিবার্য হলেও এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য। এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান কুকুরে নিয়মিত জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান। জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেয়া হয়, কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা দেশের মোট কুকুরের ৭০ শতাংশকে টিকা দিলে, ওই এলাকা বা দেশের সব কুকুরের শরীরে সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। ফলে জলাতঙ্ক ভাইরাস কুকুর থেকে কুকুরে কিংবা মানুষে সংক্রমিত হতে পারে না। অর্থাৎ ব্যাপকহারে টিকাদান নিশ্চিত করলে মানুষ ও কুকুর উভয়ই নিরাপদ থাকবে।