দুর্গোৎসব
কোমল হাতের ছোঁয়ায় পূর্ণতা পাচ্ছেন ‘মৃন্ময়ী’

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
খড়-কাদা মাটি দিয়ে প্রথমে তৈরি হয়েছে প্রতিমার অবয়ব। এরপর রং-তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে মৃন্ময়ী রূপ- এসব কাজে পুরুষদের দেখেই অভ্যস্ত সবাই। কিন্তু এখন নারীরাও করছেন এই কাজ। নারী শিল্পীর হাতে একতাল কাদা মাটি রূপ পাচ্ছে মূর্তিতে। রং-তুলির ছোঁয়ায় প্রতিমা হয়ে উঠছে ‘মৃন্ময়ী’। আর তাদের তৈরি অলঙ্কার গায়ে জড়িয়ে প্রতিমা হয়ে উঠে অপরূপ সুন্দর; দৃষ্টিনন্দন, জ্যোতির্ময়ী।
ভারতে অনেক আগে থেকেই নারী শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন। আমাদের দেশে ঠিক কবে থেকে এই ধারা চলছে তা বলা মুশকিল। তবে দিন দিন নারী প্রতিমা শিল্পীর সংখ্যা বাড়ছে।
শরীয়তপুরে এমন অন্তত ২০ জন নারী প্রতিমাশিল্পী আছেন যারা দুর্গা প্রতিমা ছাড়া বিভিন্ন পূজা-পার্বণে প্রতিমা তৈরি করেন। তাদের মধ্যে শরীয়তপুর সদরের পশ্চিম কোটাপাড়া এলাকায় রয়েছেন ঝর্ণা পাল (৩৮) ও জোৎস্না রানী পাল (৪২)। সম্পর্কে তারা জা। একই এলাকায় আরেক নারী প্রতিমা শিল্পী দিপালী রানী পাল (৫০)। তারা তিন জনই বিয়ের পর প্রতিমা তৈরির কাজ শিখেছেন। ঝর্ণা পালের স্বামী কার্তিক পাল এবং জোৎস্না রানী পালের স্বামী গোবিন্দ পাল। কার্তিক ও গোবিন্দ পাল দু’জনই বংশ পরম্পরায় এই পেশায় আছেন।
দিপালী রানী পালের স্বামী রামকৃষ্ণ পালও এই পেশায় কাজ করছেন বংশ পরম্পরায়। জোৎস্না, ঝর্ণা ও দীপালি পালও যে এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন; তাও পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। তারা তিন জনই প্রতিমা তৈরির কাজে সহযোগিতার পাশাপাশি রঙের কাজ করেন। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী প্রতিমাসহ বিভিন্ন পূজায় প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি বাড়িতে মাটির থালা-বাসন তৈরি করেন। এই থালা বাসন তৈরির কাজটি তারা ১২ মাসই করেন।
ঝর্ণা ও জোৎস্না জানান, বৈশাখ মাসেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছেন তারা। আষাঢ় মাসে প্রতিমা তৈরি শেষ হয়েছে। প্রতিমার কিছু জায়গায় ফাটল দেখা দেয়ায় সেগুলো মেরামত করার পাশাপাশি পুরোদমে চলছে রঙের কাজ।
১৮ বছর যাবত প্রতিমা তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত ঝর্ণা পাল। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, পাল বাড়ির মেয়ে হলেও আমার বাবার বাড়ি প্রতিমা তৈরির কাজ করিনি। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তাদের পূর্ব পুরুষের ব্যবসা প্রতিমা তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। এ বছর ১২টি প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছেন কার্তিক পাল। এসব প্রতিমায় শরিয়তপুর ও নড়িয়ার মণ্ডপে পূজা হবে।
ঝর্ণা পাল বলেন, প্রতিমায় চক্ষু দানের কাজটি অনেক সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। সবার চোখতো থাকে প্রতিমার চোখের দিকেই। চক্ষুদানের কাজটি করেন আমার ভাসুর হরিপাল। তিনি ঢাকায় কাজ করেন। আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি সময় করে এসে চক্ষু দান করে গেছেন।
জ্যোৎস্না রানী পাল এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ২৩ থেকে ২৪ বছর ধরে। এ বছর ৬টি প্রতিমা তৈরির বায়না পেয়েছেন তারা। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমার বাবার বাড়িতেও প্রতিমা তৈরির কাজ হয় না। বিয়ের পর এখানে এসেই কাজ শিখেছি। এ বছর যে ৬টি প্রতিমা তৈরির বায়না পেয়েছি সবগুলোই শরীয়তপুরের বিভিন্ন মণ্ডপের জন্য।
ঝর্ণা পালের তিন মেয়ে। তারা সবাই পড়ালেখা করেন। এই পেশার সঙ্গে কেউ যুক্ত নন। আর জোৎস্না পালের দুই ছেলে। তারও ঢাকায় পড়ালেখা করেন। বাবার কাজে দুই ছেলে সময় সুযোগ বুঝে সহযোগিতা করলেও সন্তানদের এই পেশায় আসতে দিতে চান না ঝর্ণা ও জোৎস্না পাল। কারণ হিসেবে বলেন, এই পেশায় যোগ্য পারিশ্রমিক নেই। মূল্যায়নও নেই।
ঝর্ণা পাল বলেন, এই পেশায় পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি খুবই কম। দিনরাত পরিশ্রমের পর যে পারিশ্রমিক মিলে তা দিয়ে সংসার চালানো দুষ্কর। আমরা স্বামী-স্ত্রী কারিগর নিয়ে কাঠামোতো মাটির প্রলেপ দেয়ার পাশাপাশি, প্রতিমা রং করা এবং প্রতিমার অলংকার তৈরি ও প্রতিমা সজ্জ্বার কাজগুলো করি। মেয়েরা এই পেশায় আসুক চাই না।
জ্যোৎস্না রানী পাল বলেন, বড় ছেলে ঢাকায় থাকে, ছোট ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ে। মাঝে মাঝে বাবার কাজে সহযোগিতা করে; কিন্তু তারা এই পেশায় আসুক তা আমি বা ওদের বাবা চায় না। না আছে যোগ্য পারিশ্রমিক, না আছে মূল্যায়ন।
২০ বছর বয়সে বিয়ের পর রামকৃষ্ণ পালের সংসারে আসেন দিপালী রানী পাল। তিনি বলেন, এই সংসারে এসে এই পেশায় যুক্ত হয়েছি। ৩০ বছর ধরে সংসারের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে বছরজুড়েই নানা পূজা উপলক্ষে প্রতিমা তৈরি করছি। স্বামী-স্ত্রীর আয়ে চলে সংসার। কিন্তু যা রোজগার তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর।
পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার কৈলাস ঘোষ লেনে ‘অনামিকা ভাস্কর শিল্পালয়’-এ প্রতিমা তৈরি করেন অনামিকা নন্দী। বাবা সুশীল নন্দীর কাজ দেখে বড় হওয়া অনামিকার শুরুটা হয়েছিল বাবাকে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজটা করছেন একান্তই ভালো লাগা থেকে। যোগ্য পারিশ্রমিক না পাওয়ার অভিযোগ অনামিকারও।
আক্ষেপ থাকলেও রঙের আঁচরে যখন দেবীর হাসিমাখা মুখ ফুটে ওঠে, তখন সব কষ্ট ও আক্ষেপ যেনো উড়ে যায়। শত শত মানুষ যখন তাদের তৈরি প্রতিমার পায়ে পুষ্পঞ্জলী দেয়; তখন দীর্ঘ কয়েক মাসের কাজেরই শুধু নয় জীবনের স্বার্থকতাও যেনো খুঁজে পান এই নারী প্রতিমা শিল্পীরা।