×

জামায়াত

জামায়াত-এনসিপি সম্পর্কে চিড়!

Icon

হরলাল রায় সাগর

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৯ পিএম

জামায়াত-এনসিপি সম্পর্কে চিড়!

ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের দল এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় চিড় ধরেছে দলটির। সাম্প্রতিক দল দুটির বক্তব্য-বিবৃতি এবং জুলাই সনদ নিয়ে বিপরীত অবস্থানের কারণে ‘সম্পর্কের টানাপড়েন’ প্রকাশ্যে আসে। দুই দলের তিক্ততা বাড়ায় এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

জামায়াতবিরোধী ধর্মভিত্তিক শক্তি বাড়াতে সমমনা ও বাম ঘরানার কিছু দল এবং জামায়াতবিরোধী ইসলামী দলের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বাড়াচ্ছে এনসিপি। এমনকি বিএনপির বলয়েরও বাইরে পাকাপোক্ত করতে চাইছে দলটি। এ কারণে ভোটের রাজনীতি ও দেশের জনগণের মনোভাবের বিষয় মাথায় রেখে নিজস্ব রাজনীতি দাঁড় করানো ও সংগঠন শক্তিশালী করার দিকে মনযোগী তরুণদের দল। বর্তমানে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে এনসিপি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবিভূর্ত হতে চাইছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো  রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও আন্দোলনের তখনকার সমন্বয়ক, এখন এনসিপির নেতাদের মধ্যে বরাবর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই দেখা গেছে। এমনকি সমন্বয়কদের মধ্য থেকেই কয়েকজন পরবর্তীতে শিবির নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিভিন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়লাভও করেছেন।

এছাড়া শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়াদের অনেকে পরোক্ষভাবে ‘জামায়াত বা শিবিরেরই লোক’ এমন প্রচারণাও রাজনৈতিক অঙ্গনে আছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনেও তারা মুখ্য ভ‚মিকা রাখেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই সমন্বয়ক বা ছাত্রনেতারা গড়ে তুলেন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এর আহবায়ক হলেন নাহিদ ইসলাম, যিনি বর্তমান সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন। নতুন দলের আত্মপ্রকাশের পরও জামায়াতের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট সুসম্পর্কই দেখে আসছে দেশবাসী। এনসিপি নেতারা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন সময় নানা সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে পোস্টও দিয়েছেন। বিএনপিরও অনেক নেতা এনসিপির নেতাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন- যা গণমাধ্যমেও এসেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে তেমন কোনো নেতিবাচক বক্তব্য এনসিপির দিক থেকে বিগত দিনে আসেনি। এমনকি এনসিপির গঠিত হওয়ার আগেই ‘অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে জামায়াতের কাফফারা হয়ে গেছে’ নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। একইভাবে রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন, জাতীয় নির্বাচনের আগে এর আইনিভিত্তি এবং নির্বাচনের জন্য পিআর ইস্যুতে এনসিপি ও জামায়াত সোচ্চার ছিল।

তবে নির্বাচনে পিআর ও গণভোট ইস্যুতে জামায়াতের আন্দোলনের সঙ্গে যায়নি এনসিপি। এমনকি জুলাই সনদ স্বাক্ষরও করেনি দলটি। জামায়াতের পাঁচ দফা দাবির আন্দোলন এবং এর বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আওয়ামী লীগবিরোধী সমমনা ও বাম ঘরানার কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপি। মূলত তখন থেকেই জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে বলে মনে করছেন দলের সংশ্লিষ্টরা। দুই বৃহৎ বলয় বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় ১৮ সেপ্টেম্বর গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং গণতন্ত্র মঞ্চের নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) বৈঠক করেলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এ দলগুলো জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন, সনদের আইনিভিত্তি ও সংবিধান সংস্কারে সাংবিধানিক সভা চায়। 

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, এনসিপির নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি নিজস্ব রাজনীতি দাঁড় করানো, সংগঠন শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা চ‚ড়ান্তকরণ এখন এনসিপির সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিদ্যমান দুই বলয়ে এনসিপি যাচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক অভিপ্রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা এখন আওয়ামী লীগের ভোটটা টানতে চাচ্ছে। আর জামায়াতের কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি, জুলাই সনদ ও বিচার সংস্কারের বিষয়ে এক ধরনের ঢিমেতাল। তারা জুলাইয়ের স্পিরিট, বিচার সংস্কারের চেয়ে এখন নির্বাচনের দিকেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে।’ সামান্তা শারমিন বলছেন, ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র, গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধানের জন্য দীর্ঘসময় ধরে যুক্তিতর্ক তুলে ধরছে এনসিপি।

এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম রবিবার হঠাৎ করে তীর্যক মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে তিনি লেখেন- ‘জামায়াতে ইসলামীর তথাকথিত পিআর আন্দোলন একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা। আন্দোলনটি ইচ্ছাকৃতভাবে গঠিত হয়েছিল ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া ভ্রান্ত পথে চালিত এবং জনগণের অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সংবিধান পুনর্গঠন-সংক্রান্ত জাতীয় সংলাপ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য। তাদের উদ্দেশ্য ছিল না সংস্কার, বরং ছিল কৌশলী প্রতারণা। ঐকমত্য কমিশনে জামায়াতের হঠাৎ করে ‘সংস্কারের’ পক্ষে অবস্থান নেয়া আদর্শগত বিশ্বাসের প্রকাশ ছিল না, বরং এটা ছিল একটি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ, সংস্কারের ছদ্মবেশে নাশকতা। বাংলাদেশের জনগণ এ প্রতারণা পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছে, তারা কখনো কোনো ভুয়া সংস্কারবাদী বা ষড়যন্ত্রকারী শক্তির দ্বারা প্রতারিত হবে না। না সর্বশক্তিমান, না এ দেশের সার্বভৌম জনগণ- কেউই আর কখনো অসৎ, সুবিধাবাদী ও নৈতিকভাবে দেউলিয়া শক্তিগুলোকে শাসন করার সুযোগ দেবে না।’

এনসিপি নেতার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জামায়েতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দায়িত্বশীল জায়গা থেকে নাহিদ ইসলামের পিআর নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন ইস্যুতে এ ধরনের বক্তব্য অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য- যা কোনোভাবে সমর্থন করে না জামায়াতে ইসলামী।’ এর এক দিন পর সোমবার জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এনসিপিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা ছাত্রদের নতুন দল। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে তোমাদের আরো বহুদূর যেতে হবে। জন্ম নিয়েই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিও না।’ ছাত্রদের দলের নেতা দুঃখজনক পোস্ট দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা চাচ্ছেন আমরা যেন তাদের সমালোচনা করি, কিন্তু কেউ তো তাদের নামই নিচ্ছে না। 

এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, রাজনীতিতে একপক্ষ আরেকপক্ষকে ব্যাশিং করে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকে। তবে এনসিপিকে নিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার যে বক্তব্য দিয়েছে সেটি শুধু অসৌজন্যমূলকই না, রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণও বটে। 

এদিকে এনসিপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বেশ কিছু দল প্রকাশ্যে শঙ্কা ও আপত্তির কথা জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সবচেয়ে তীব্র সমালোচনা আসে হেফাজতের আমীর মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর কাছ থেকে। সম্প্রতি হাটহাজারীতে এক সম্মেলনে তিনি বলেন, মওদুদী ফিতনা প্রতিহত না করলে দেশে ইসলাম থাকবে না। মওদুদীবাদীরা সাহাবিদের সত্যের মাপকাঠি মানে না। ইসলামের পর্দা প্রথাকে তারা অস্বীকার করে। এর আগে নাজিরহাটে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘জামায়াত সহিহ ইসলামি দল নয়। আমাদের ইসলাম মদিনার ইসলাম, মওদুদীর ইসলাম নয়। মওদুদীর ইসলাম করলে ইমান থাকবে না।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘জামায়াত দেশে মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের ঐক্যের প্রশ্নই আসে না।’

এদিকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক সমাপ্রতি এক গণমাধ্যমকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সুসংগঠিত ইসলামি রাজনৈতিক দল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সঙ্গে তাদের কিছু মতপার্থক্য আছে। তাই জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করলে আমাদের জনশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।’

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর বক্তব্যও অনেকটা এরকমই। তিনি বলেন, ‘জোটের ক্ষেত্রে আমাদের মূলনীতি স্পষ্ট, আমরা এমন কারো সঙ্গে জোট করতে চাই না, যার ফলে হাজার বছরের ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা ও দর্শন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দ্বীনের মৌলিক অনেক বিষয়ে আলেমদের দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও তারা সুসংহত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। দ্বীন, ইমান ও শরিয়তের বহু বিষয়ে আলেমদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বাইরে তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

বাড়লো জ্বালানি তেলের দাম

বাড়লো জ্বালানি তেলের দাম

শাহজালালে ভয়াবহ আগুন: ব্যবসায়ীদের সহায়তায় বিশেষ তহবিলের আহ্বান

শাহজালালে ভয়াবহ আগুন: ব্যবসায়ীদের সহায়তায় বিশেষ তহবিলের আহ্বান

আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লো স্বর্ণের দাম

আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লো স্বর্ণের দাম

শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে ব্যবধান দূর করার আহ্বান

শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে ব্যবধান দূর করার আহ্বান

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App