ক্যাম্পাসে মাদকের বিরুদ্ধে আইন পাসের উদ্যোগ নেব: জাকসু ভিপি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৩৯ পিএম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) নবনির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) আব্দুর রশিদ জিতু। ছবি: ভোরের কাগজ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) নবনির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) আব্দুর রশিদ জিতু। বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রভাবের বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা তাদের নেতা হিসেবে কেন বেছে নিলেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে? তার নেতৃত্বগুণ ও প্রচারণা কৌশলে কী এমন বৈশিষ্ট ছিল, যা মন জয় নিল হাজার হাজার শিক্ষার্থীর? আর দায়িত্ব নেয়ার পর এখন শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাসের উন্নয়নে কীভাবে ভূমিকা রাখতে চান তিনি? ভোরের কাগজকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আব্দুর রশিদ জিতু। তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি তানভীর ইবনে মোবারক। প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো বিস্তারিত-
ভোরের কাগজ : দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। এই অর্জনে আপনার অনুভূতি কী?
আব্দুর রশিদ জিতু : জাকসুর ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আমি যেমন আনন্দিত; এর চেয়েও বেশি আনন্দিত এজন্য যে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী আমাকে ভিপি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি, আমার ওপর আস্থা রাখার জন্য।
ভোরের কাগজ : গণঅভ্যুত্থানের পর দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল এই জাকসু নির্বাচন আয়োজনে আপনি অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছেন। এবার শিক্ষার্থীদের নিয়ে কীভাবে কাজ করবেন? কোনো পরিকল্পনা করেছেন?
আব্দুর রশিদ জিতু : শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আমি সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি। ব্যক্তিগতভাবে জাকসুর নেতা হওয়ার চেয়ে আমার কাছে মুখ্য বিষয় ছিল ৩৩ বছর ধরে আমরা যে অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি, সেই অধিকার বাস্তবায়ন করা। শিক্ষার্থীরা আমাকে ভোটের মাধ্যমে যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন, আমি চেষ্টা করব, এতদিন তারা যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন, সবাইকে নিয়ে সেগুলো ফিরিয়ে আনার। সবাইকে পাশে পেলে সব অধিকার আদায়ের চেষ্টা করবো।
ভোরের কাগজ : জাকসুতে শিবিরের প্যানেল থেকে প্রায় ২০ জন জয়ী হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে আদর্শগত জায়গা থেকে কোনো সমস্যা হবে কিনা?
আব্দুর রশিদ জিতু : দেখুন, জাকসুতে যে বা যারা নির্বাচিত হয়েছে তারা কিন্তু দলীয় আদর্শ প্রচার করার জন্য এখানে আসেননি। তারা এখানে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য, চাওয়া পাওয়া বাস্তবায়নের জন্য এসেছেন। শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করার জন্য তারা এসেছেন। একইভাবে আমিসহ যারা শিবিরের প্যানেলের বাইরে নির্বাচিত হয়েছি; তারাও একই কাজ করার জন্য এসেছি। সুতরাং কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি আমরা হব না, কোনো জটিলতা তৈরি হবে না। আমাদের মতাদর্শ একপাশে রেখে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আমরা কাজ করে যাব।
ভোরের কাগজ : মাদক সিন্ডিকেটের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকরী কী পদক্ষেপ নেবেন?
আব্দুর রশিদ জিতু : মাদকের বিরুদ্ধে আমার সবসময় জিরো টলারেন্স ছিল। যেটা আমি ইশতেহারে উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যেই অনেক শিক্ষার্থী মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যা আশঙ্কাজনক। আমরা তাদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করব। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসের আশপাশে যারা মাদক সিন্ডিকেট চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। একই সঙ্গে মাদকের বিরুদ্ধে যেন একটি আইন পাস করা হয় (যারা এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে যেমন মাদকসেবন, মাদক পরিবহন, মাদক ব্যবসা) সেটি নিশ্চত করব। ক্যাম্পাসের কোনো শিক্ষার্থীও যেন মাদকের কারণে ঝরে না পড়ে সেই ব্যবস্থা করব।
ভোরের কাগজ : আপনি জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা নির্বাচনের আগে অনেকে সামনে নিয়ে এসেছে। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে সামনে কোনো অন্তরায় হবে কিনা?
আব্দুর রশিদ জিতু : তৎকালীন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল সে হিসেবে আমি হলে ওঠার পর পলিটিক্যাল ব্লকে থেকেছি। তখনও আমি চেষ্টা করেছি বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। এজন্য তখনো আমি শিবির ট্যগিংয়ের শিকার হয়েছি। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে ছাত্রলীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমি রাজপথে ছিলাম এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শেষ হয়ে গিয়েছিল; তখন অনেকে ঘরে ফিরে গেলেও আমি কিন্তু ঘরে ফিরে যাইনি, শেষ দিন পর্যন্ত আমি আমার লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। ১৫ জুলাই যেদিন জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগ আক্রমণ করে; সেদিন কিন্তু আমি তাদের হাতে মার খাই এরপর থেকে আমি সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে ছিলাম। বিবেকের তাড়নায় তখন শত শত শিক্ষার্থী যারা ছাত্রলীগ করত, তারাও এই যৌক্তিক আন্দোলনে যোগ দেয়। সুতরাং আমার কাছে এই ছাত্রলীগের ট্যাগিং আর কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আমিসহ যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তারা কিন্তু তখন থেকেই এদের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন করে গিয়েছি, যা আসলে আন্দোলনকে বেগবান করে। তাই নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের বিষয়টি সামনে নিয়ে এলেও জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তি জিতুকে আস্থাভাজন হিসেবে ভোট দিয়েছে; সুতরাং আমি তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে চাই।
ভোরের কাগজ : আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও এখানে গণরুম, গেস্টরুম কালচার চালু ছিল, যা এখন নেই। এটা যেন আর ফিরে না আসে সেজন্য আইনি কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা?
আব্দুর রশিদ জিতু : অভ্যুত্থানের পর আমরা গণরুম কালচার, গেস্টরুম কালচার জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এরপর কোনো দল যদি এই কালচারগুলো ফিরিয়ে এনে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, তাহলে আমরা তাদেরকে রুখে দেব এবং গণরুম-গেস্টরুম কালচারসহ র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়, এসবের বিরুদ্ধে আগামী সিন্ডিকেটে যেন আইন পাস করা হয়, সেই দাবি জানাব।
ভোরের কাগজ : জাকসুর ভিপির দায়িত্ব পালন শেষে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হবেন কিনা?
আব্দুর রশিদ জিতু : আমি প্রথমত চেষ্টা করব যেন, আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে। শিক্ষার্থীরা আমাকে যে আমানত দিয়েছেন তার কোনো খেয়ানত করতে চাই না। এই মেয়াদ শেষে আমি জাতীয়ভাবে দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করার চেষ্টা করব। তখন যদি আমার কোনো দলের হয়ে কাজ করার সুযোগ আসে, আমি সেটা করব। তবে আওয়ামী লীগ বা এর ছায়া-সংশ্লিষ্ট কোনো দলের সঙ্গে আমি যাব না। এর বাইরে কোনো দল যদি জনমানুষের স্বার্থে কোনো কাজ করে, যারা তারুণ্যকে অগ্রাধিকার দেবে, মেধাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি করবে, তাদের সঙ্গে যাব। যাদের মধ্যে পুরনো সিলসিলা, পরিবারতন্ত্র কায়েম ফ্যাসিবাদের মনোভাব থাকবে, তাদের সঙ্গে আমি রাজনীতি করব না। যারা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য, অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে নতুন স্বপ্ন নিয়ে কাজ করবে, তারা যদি কোনো ছোট দলও হয়, আমি তাদের সঙ্গে যাব। কিন্তু ভবিষ্যতে দেশের মানুষের স্বার্থে রাজনীতি করার ইচ্ছা আছে।
ভোরের কাগজ : অভ্যুত্থানের পর আপনি গ্রামের বাড়িতে এখনো যাননি। ভিপি হয়ে বাড়িতে গেলে এলাকাবাসী কীভাবে আপনাকে বরণ করা নেবে?
আব্দুর রশিদ জিতু : বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম এক রাতের জন্য। আমার এলাকাসহ পুরো জেলায় সবার স্বার্থে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এখন ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বাড়িতে গেলে আমি বিশ্বাস করি তারা আমাকে বরণ করে নেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলে এলাকায় বড় একটা জনসমাগম হবে এবং সেটি জনসমুদ্রে রূপ নেবে।
ভোরের কাগজ : আপনাকে ধন্যবাদ।
আব্দুর রশিদ জিতু : আপনাকে এবং ভোরের কাগজ ও এর সকল পাঠককেও ধন্যবাদ।