মিডসামারের উৎসব
সূর্য না ডোবার দেশে এক অনন্ত নাচ ও ভালোবাসার দিন
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ০৩:৫১ এএম

সুইডেনে মিডসামার উৎসবে লেখক রহমান মৃধা, তার সহধর্মিণী মারিয়া ও অন্যান্যরা
সুইডেনের সবচেয়ে প্রিয় ও আবেগঘন উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মিডসামার—একটি দিন যেখানে সূর্য ডোবে না, আকাশজুড়ে থাকে কেবল আলো আর উজ্জ্বলতা, প্রকৃতি থাকে তার পরিপূর্ণ যৌবনে, আর মানুষের হৃদয় জেগে ওঠে প্রেম, স্মৃতি আর মিলনের এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায়। এটি কেবল একটি ঋতু পরিবর্তনের উৎসব নয়—এ যেন সুইডিশ আত্মার এক অব্যক্ত গান, একটি জাতির আত্মপরিচয়ের নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ।
ঐতিহাসিক শেকড় ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন
মিডসামারের উৎসব রয়েছে সুইডেনের কৃষিভিত্তিক সমাজে। এই উৎসব প্রাচীনকালে পালন করা হতো গ্রীষ্ম ও উর্বরতার আগমন উদযাপন করতে। তখন মানুষ নিজেদের শরীর ঢেকে ফেলতো সবুজ পাতায়, তৈরি হতো ‘সবুজ মানুষ’, ঘরবাড়ি সাজানো হতো গাছের ডালপালা দিয়ে। মূল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকত ‘মিডসামার ইস্তং’ বা মেপোল—পাতা ও ফুলে মোড়া লম্বা এক খুঁটি, যার চারপাশে সবাই মিলে নাচতো, গাইতো আর আনন্দ করতো। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এর অস্তিত্ব দেখা যায় ১৫০০ শতক থেকেই।
আধুনিক মিডসামার: উৎসবের প্রাণস্পন্দন
আজকের দিনে, মিডসামার শুধুই ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত সামাজিক অভিজ্ঞতা। দিনটি শুরু হয় প্রাকৃতিক ফুল তোলার মধ্য দিয়ে। বাচ্চারা মা-বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে ফুল সংগ্রহ করে, তৈরি করে পুষ্পমাল্য। এরপর সবাই মিলে গ্রামের খোলা মাঠে মেপোল স্থাপন করে এবং তার চারপাশে হাত ধরে গোল হয়ে নাচে, হাসে, আনন্দে মাতোয়ারা হয়।
তরুণ-তরুণীরা এই অংশে তুলনামূলক কম সক্রিয় হলেও সন্ধ্যার দিকেই শুরু হয় তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত স্বাধীন ও রঙিন পর্ব—যেখানে থাকে গান, স্ন্যাপস, আর অনেক স্মৃতি মেশানো আলাপচারিতা।
আনন্দের রসনাতৃপ্তি: সুইডিশ খাবার ও গান
মিডসামার মানেই সুইডিশ খাবারের এক অপূর্ব মহোৎসব। সুইডিশ মিডসামারে কী খাওয়া হয়? একটি রুচিপূর্ণ, ঐতিহ্যভিত্তিক খাবারের তালিকা-
শুরুতেই – সাধারণত ঠাণ্ডা খাবার
• বিভিন্ন স্বাদের ঝাল-টক সিল মাছ – সিল মাছ দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পরিচিত চ্যাপলে মাছের মতো—চ্যাপ্টা দেহ, মসৃণ ত্বক এবং সাধারণত ছোট আকারের হয় এবং এটি মিডসামারের অনিবার্য অংশ (যেমন: সরিষার সিল, পেঁয়াজ সিল, রসুন সিল, ম্যাটজেস সিল)
• সাওয়ার ক্রিম (টক দই) ও গ্রাস অনিয়ন (চিভস – এক ধরনের পেঁয়াজপাতা) – সিলের সঙ্গে খুব জনপ্রিয়
• ডিলসহ সেদ্ধ নতুন আলু – গরম গরম পরিবেশন করা হয়
• সেদ্ধ ডিমের উপর চিংড়ি বা মাছের ডিম (রোম) – সাজানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়
• ক্নেকেব্রোড (খসখসে হার্ড ব্রেড) ও মাখন, সঙ্গে থাকে সুইডিশ শক্ত চিজ
মূল খাবার – সাধারণত গ্রিল করা হয়
• গ্রিল করা স্যামন, সসেজ বা মাংস – যেমন: এন্ট্রিকোট, ল্যাম্ব চপ, টি-বোন স্টেক, ফ্লেশকারে (মাংসের কেক), স্পেয়ার রিব
• ভাস্টারবোটেন পাই – ভাস্টারবোটেন নামক সুগন্ধি ও ঝাঁঝালো পনির দিয়ে তৈরি এক ধরনের কিশ বা কেক
• তাজা সবজির সালাদ বা ঠাণ্ডা আলুর সালাদ – গ্রীষ্মে খুবই জনপ্রিয়
ডেজার্ট – গ্রীষ্মকালীন ফলমূল দিয়ে
• স্ট্রবেরি কেক – ভ্যানিলা স্পঞ্জ কেকের উপর হুইপড ক্রিম ও তাজা স্ট্রবেরি
• স্ট্রবেরি ও ক্রিম অথবা আইসক্রিম
• রাবার পাই – টক-মিষ্টি রাবার ফল দিয়ে তৈরি পাই, সাধারণত ভ্যানিলা সস সহ পরিবেশন করা হয়
পানীয়
• ঠাণ্ডা বিয়ার – হালকা বা মাঝারি ঘনত্বের
• স্ন্যাপস – সুগন্ধি, মশলাযুক্ত সুইডিশ ঐতিহ্যবাহী মদ (যেমন: ও.পি. অ্যান্ডারসন, স্কনে আকভাভিত)
• স্ন্যাপস গান – প্রতিবার পান করার আগে বা পরে গাওয়া হয় মজাদার ঐতিহ্যবাহী গান
এছাড়াও: কোলা, ফান্টা, মিনারেল ওয়াটার, লেমনেড – শিশু ও যারা অ্যালকোহল পান করেন না তাদের জন্য সহজলভ্য
অতিরিক্ত তথ্য:
মিডসামারের খাবার সাধারণত বাইরে পরিবেশিত হয়—যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে। অনেক সময় খাওয়ার স্থান সাজানো হয় সুইডিশ জাতীয় পতাকা, বুনো ফুল, আর মেপোলের আশেপাশে ছোট ছোট ব্যানার দিয়ে।
এই ভোজ শুধু উদরপূর্তি নয়; বরং এটি পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার আনন্দ, ঐতিহ্য ভাগাভাগি করার আন্তরিকতা এবং প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি জীবন্ত উপলক্ষ —সব মিলিয়ে এক ভোজনরসিকের স্বপ্নপুরী। সঙ্গে থাকে ঠাণ্ডা বিয়ার এবং মশলাদার স্ন্যাপস। প্রতিবার পানীয় ঢালার সময় উঠে আসে গান—লোকসংগীত, হাসি, আর একসাথে থাকার আনন্দ।
নস্টালজিয়া, প্রেম ও মানবিক সংযোগ
এই উৎসব কেবল নাচ-গান নয়, এটি এক গভীর মানবিক সংযোগের বহিঃপ্রকাশ। সুইডিশদের মনে গেঁথে থাকা এক নির্দিষ্ট ভাবনা আছে যে, মিডসামার ঠিক কী রকম হওয়া উচিত। এটি নস্টালজিয়ার এক জীবন্ত আবরণ—যেখানে মানুষ ফিরে পায় নিজের শৈশব, পারিবারিক বন্ধন, আর কিছু অনির্বচনীয় স্মৃতির টুকরো।
লোককথায় আছে, এই রাতটি প্রেমের জন্য জাদুকরী। বহু সম্পর্ক এই রাতে পরীক্ষা দেয়। কোনোটি হয়তো বিয়ের দিকে এগোয়, আবার কোনোটি বিচ্ছেদের খাতে গড়ায়। আর কেউ কেউ এই সময় বেছে নেয় গির্জার পুষ্পমাল্য-সজ্জিত পথ দিয়ে নতুন জীবনে পা রাখতে।
ঋতুচক্রে জীবনের পাঠ: আলো, অন্ধকার ও প্রত্যাবর্তন
মিডসামারের সূর্য না ডোবার আলো আমাদের মনে জাগায় এক নবজাগরণের অনুভূতি। এরপর আসে সুইডিশ গ্রীষ্ম—দীর্ঘ দিন, উষ্ণ আবহাওয়া, পিকনিক, সাঁতার আর বাগানচর্চার দিন। ধীরে ধীরে সেই দিন ছোট হতে থাকে, আসে শরৎ, আসে শীত। উত্তর সুইডেনের কিছু জায়গায় ‘পোলার নাইট’-এ দিনের আলো প্রায় হারিয়ে যায়।
তবু মানুষ থেমে থাকে না। আলোহীন দিনেও তারা খুঁজে নেয় ঘরের উষ্ণতা, প্রিয়জনের সান্নিধ্য, গরম কফি আর মোমবাতির আলোয় এক নতুন জীবনের রঙ। এবং মানুষ জানে—আবার আলো আসবে। আবার বসন্ত আসবে। আবার উৎসব হবে।
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের উৎসব
মিডসামার হলো একত্রিত হওয়ার উৎসব। স্কুল ছুটি থাকার কারণে পরিবারের সবাই একসঙ্গে হতে পারে। পিতামাতা, সন্তান, দাদা-দাদী—সবাই মিলে সাজায় দিনটি। প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে মাঠে বা পার্কে মেপোল স্থাপন করে, একসাথে গান গায়, নাচে। এই মিলন মানুষের সামাজিক চেতনাকে উজ্জীবিত করে। পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা, একসাথে রান্না, গল্প—সব মিলিয়ে এক মানবিক নিকটতা গড়ে তোলে।
প্রেরণার প্রতীক: ১০০ বছরের সেসটিন এরিকসন
গত বছর মিডসামারে অংশ নিয়েছিলাম আমার বন্ধু ডা. মাইকেল ও তার স্ত্রী ডা. লেনার আমন্ত্রণে। তাঁদের ৯৯ বছর বয়সী মা, সেসটিন এরিকসন, ছিলেন আমাদের সাথে। সেই বয়সেও তিনি সারাদিন নেচেছেন, গান গেয়েছেন, সমুদ্র ভ্রমণে গেছেন। তাঁকে দেখে মনে হয়েছে, ভালোবাসা ও প্রকৃতির সংস্পর্শেই জীবন থাকে তরতাজা।
এবছরও এসেছি দিনটি উদযাপন করতে বাল্টিক সাগরের তীরে একটি দ্বীপে। মিডসামারে নতুন প্রেরণার প্রতীক: ১০০ বছরের সেসটিন এরিকসন। গত মাসে সেসটিন ১০০ বছরে পা দিয়েছেন।
সেসটিনের জীবন আমাদের শেখায়—প্রকৃতির সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক প্রশান্তি এবং পরিবার ও সমাজের সংযুক্তি একজন মানুষকে শতবর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। সেসটিন যেন আমাদের সময়ের জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
একটি বৃহত্তর বার্তা: বিশ্বে শান্তি, সংস্কৃতি ও একতা
যখন পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ, দুর্নীতি, ভ্রাতৃঘাতি বিভাজন আর হতাশা; তখন সুইডেনের মিডসামার আমাদের শেখায়—আনন্দ ও শান্তি সম্ভব। এই উৎসব একটি বার্তা দেয়—একতা ও সংস্কৃতি ধরে রাখলে মানুষ কোনো সংকটেই হার মানে না। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সম্পর্কের যত্ন, আর ক্ষুদ্র আনন্দের অন্বেষণই জীবনের বড় সত্য।
প্রকৃতি, প্রেম ও প্রতিরোধের সঙ্গীত
মিডসামার হলো প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মিক বন্ধনের এক গান। এটি যেমন সূর্যের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসে, তেমনি আমাদের হৃদয়ে জাগায় মানবিক মূল্যবোধ, সম্পর্কের শিকড়, এবং আশার আলোকচ্ছটা। ১০০ বছরের সেসটিন থেকে শুরু করে কিশোরের প্রথম প্রেম—সবার জন্য মিডসামার একটি বার্তা দেয়—আলো আবার ফিরবে। জীবন আবার হাসবে। আর প্রেম? সে তো সবসময়ই আমাদের চারপাশে, প্রকৃতির মতোই নীরব, কিন্তু চিরন্তন।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]