কপ৩০ এর অষ্টম দিনে এআই নিয়ে উদ্বেগ
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
কপ৩০-এর ৮ম দিনে বেলেমে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার জোরদার আহ্বান জানালেও আলোচনা বেশ ধীরগতিতে আগাচ্ছে। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন, জীবাশ্ম জ্বালানির রূপান্তর, জেন্ডার ও ন্যায্যতার প্রশ্নে বিভাজন দূর করতে এখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথম সপ্তাহের কারিগরি টানাপোড়েন পেরিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগ, লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল ও বৈশ্বিক অর্থায়ন কাঠামোতে অচলাবস্থা ভাঙার দায়িত্ব এখন তাদের হাতে। জ্যামাইকায় সংঘটিত হারিকেন মেলিসার ধ্বংসযজ্ঞ ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সারাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি ও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটিয়েছে উল্লেখ করে দেশটি ধনী দেশগুলোর নির্গমন হার হ্রাস এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
কিউবা, মরিশাসসহ অন্যান্য দ্বীপরাষ্ট্রও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত ক্ষতিকে এখন তাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা এবং এটি মোকাবিলা করা “নৈতিক কর্তব্য” বলে উল্লেখ করেছে। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল এবং ব্রাজিলের নেতৃত্বও সতর্ক করেছেন যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রতিটি অতিরিক্ত অংশ মানবজীবন ও অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে। এদিকে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষতি-ক্ষয়ক্ষতির তহবিল সংক্রান্ত কিছু প্রযুক্তিগত বিষয়ে অগ্রগতি হলেও কার্বন বাজার, জেন্ডারভিত্তিক আলোচনা, জাস্ট ট্রানজিশন এবং অভিযোজন কর্মসূচির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এখনও আটকে আছে। সবচেয়ে বিতর্কিত ক্ষেত্র: অর্থায়ন, বাণিজ্য, স্বচ্ছতা এবং বর্তমান এনডিসিগুলির দুর্বলতার বিষয়টি খুবই কম অগ্রগতি হয়েছে। ব্রাজিলের কপ প্রেসিডেন্ট সম্ভাব্য পথনির্দেশ দিতে একটি নোট প্রকাশ করেছেন, যেখানে এনডিসি শক্তিশালীকরণের রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কপ৩০ এ দক্ষিণ কোরিয়া ঘোষণা করেছে যে তারা ২০৪০ সালের মধ্যে সকল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করবে এবং ‘পাওয়ারিং পাস্ট কোল অ্যালায়েন্স’-এ যোগ দিবে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশটির এই সিদ্ধান্ত অস্ট্রেলিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে বছরে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলারের কয়লা আমদানি করে। বিশ্লেষকদের মতে, কোরিয়ার পদক্ষেপ জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরশীলতা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তিশালী রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ান ট্রেজারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে দেশের জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা অস্ট্রেলিয়াকে গ্রীণ শিল্প, যেমন: গ্রীণ টেকনোলজি ব্যবহার করে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ৮২ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
অপরদিকে, কপ৩০-এ জাস্ট ট্রানজশন অর্জনের লক্ষ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের বাধা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোসহ একদল দেশ পূর্ববর্তী প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে একটি নতুন প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তাব করেছে, যেখানে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং নির্গমন হ্রাস পদ্ধতি উল্লেখিত হবে। আরব গ্রুপের প্রভাবশালী সদস্য সৌদি আরব এবং আফ্রিকান গ্রুপ এই ধরনের তথ্য-উপাত্তকে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেছে। তবে, জীবাশ্ম জ্বালানি অ-প্রসারণ চুক্তি উদ্যোগের সদস্য কলম্বিয়া আগামী বছরের এপ্রিলে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
২০০ টিরও বেশি মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী গোষ্ঠী জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিলের বিরুদ্ধে জলবায়ু আলোচনায় আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নকে উৎসাহিত করার অভিযোগ করেছে। খোলা চিঠিতে স্টিলের বিরুদ্ধে আদিবাসী, পরিবেশ ও অন্যান্য মানবাধিকার রক্ষাকারী নাগরিক সমাজ এবং তাদের পক্ষে দাঁড়ানো কর্মীদের জন্য এক শীতল হুমকি এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ব্রাজিলের আমাজনে অনুষ্ঠিত কপ৩০-এ শিল্প কৃষি খাতের ব্যাপক উপস্থিতি জলবায়ু আলোচনার স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং কার্যকারিতার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করেছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বন উজাড় ও খাদ্য উৎপাদন খাতের স্বার্থ সংরক্ষণকারী ৩’শরও বেশি লবিস্ট অংশগ্রহণ করেছেন, যা গত বছরের বাকু সম্মেলনের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই সরকারি প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত, যারা আলোচনার মূল নীতিমালা প্রণয়নে বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, গবাদি পশু পালন, শিল্প খাদ্য উৎপাদন এবং কীটনাশক ব্যবহারের মতো খাতগুলোতে কোনও পরিবর্তন না আনলে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য, বিশেষ করে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উষ্ণায়ন সীমিত করা, অসম্ভব হয়ে যাবে। আমাজনের বন উজাড়ের প্রধান কারণ হিসেবে গবাদি পশু পালন ও পশুখাদ্যের শিল্প উৎপাদন চিহ্নিত হয়েছে, যা পানির সংকট, জমি পরিষ্কার এবং জীববৈচিত্র্যহানি বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করান, যতক্ষণ পর্যন্ত বড় কৃষি কর্পোরেশন এবং লবিস্টদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রবেশাধিকার সীমিত করা হবে না, ততক্ষণ ন্যায্য, টেকসই এবং জলবায়ু-স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
কপ৩০-এ নাগরিক সমাজের কর্মীরা বেলেম অ্যাকশন মেকানিজম (বাম)-এর সমর্থনে ব্যাজ পরে জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবি জোরদার করছেন। জাস্ট ট্রানজিশনের ধারণা মূলত শ্রমিক আন্দোলন থেকে উঠে এলেও এখন এটি জলবায়ু নীতিতে প্রভাবিত সকল খাত জ্বালানি, খনিজ, কৃষি ও ফ্রন্টলাইন সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। প্যারিস চুক্তির প্রস্তাবনায় জাস্ট ট্রানজিশনের স্বীকৃতি থাকলেও তা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নেই। সমর্থকদের মতে, বাম এই শূন্যতা পূরণ করবে, দেশগুলিকে জাস্ট ট্রানজিশনের অগ্রগতি ট্র্যাক করা, সমন্বয় জোরদার করা, প্রযুক্তি ও সর্বোত্তম অনুশীলন ভাগ করা এবং বিশেষ করে নিম্নআয়ের দেশগুলোকে বাস্তবায়নে সহায়তা করতে উৎসাহিত করবে।
সম্মেলনের ব্লু জোনে আদিবাসী প্রতিনিধিদের উপস্থিতি দৃশ্যমান হলেও আলোচনায় তাদের ভূমিকা সীমিত; তারা মূলত পর্যবেক্ষক। তাদের দাবি আমাজন রক্ষা, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ, এবং বৈশ্বিক একমাত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। তবে বিশাল, ক্ষমতাধর প্রতিনিধিদলের ভিড়ে আদিবাসীদেরকে এক প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়। রবিবার সকালে আদিবাসী গুয়ারানি কাইওয়া নেতা ভিসেন্তে ফার্নান্দেস ভিলহালভা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন, যা ভূমি অধিকার ও পরিবেশ রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের দীর্ঘদিনের উদ্বেগজনক ও লজ্জাজনক রেকর্ডকে আরো একবার স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান উদ্বেগ জলবায়ু অর্থায়ন; বাংলাদেশের হেড অব ডেলিগেশন ফরিদা আখতার এটিকে বাঁচা-মরার প্রশ্ন হিসেবে বর্ণনা করেন এবং সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছানোর দাবি জানান। গত বছর ঘোষিত ৩’শ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দেরি ও ঋণনির্ভর প্রস্তাব হতাশা বাড়িয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিল বলেন, ইচ্ছা থাকলেও গতি নেই। ব্রাজিল প্রেসিডেন্সির খসড়া রূপরেখায় এনডিসি শক্তিশালী করা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে রূপান্তরের প্রস্তাব থাকলেও বৃহৎ উৎপাদক দেশগুলো আপত্তিতে অনড়। চূড়ান্ত নথিতে ‘ফেজ-আউট’ শব্দটি থাকবে কি না, তা নিয়েও মতভেদ অনেক, বিশেষত ১ হাজারের বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টের উপস্থিতি এটিকে প্রভাবিত করছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সাধারণত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার ও উচ্চ নির্গমনের জন্য সমালোচিত হলেও, কপ৩০-এ কিছু বিশেষজ্ঞ যুক্তি দিচ্ছেন যে এআইকে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ইতিবাচক শক্তি হিসেবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে। জাতিসংঘ ও ব্রাজিল নতুন এআই ক্লাইমেট ইনস্টিটিউট গঠন করেছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবেশগত সমস্যা সমাধান এবং নির্গমন কমাতে এআই ব্যবহারে সহায়তা করবে। এআই কৃষি, পরিবহন ও শক্তি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি বিশ্লেষণ আরো নির্ভুল করা-এমন নানা খাতে উপকার দিতে পারে বলে সমর্থকরা মনে করেন। কিছু গবেষণা অনুযায়ী, আগামী দশকে এআই ব্যবহার করে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস ৩ দশমিক ২ থেকে ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন পর্যন্ত কমানো সম্ভব। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এই ধারণার সঙ্গে একমত নন। জেনারেটিভ এআই’র দ্রুত বিস্তার ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ ও পানি খরচ বাড়াচ্ছে এবং নির্গমনও বাড়াচ্ছে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে এআই’র বর্তমান বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৪ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন হবে।
সমালোচকরা বলছেন, এআই কখনোই জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের বিকল্প নয়। বরং একই প্রযুক্তি আরো বেশি তেল উত্তোলনে সহায়তা করতে পারে, যা জলবায়ু সংকটকে আরো গুরুতর করবে। তাদের মতে, ‘ভালোর জন্য এআই উদ্যোগ’ কিছু উপকার করতে পারে, তবে এটি মূলত লাভ-নির্ভর একটি শিল্পের অংশ বিশেষ।
