×

মুক্তচিন্তা

ওসমান হাদির মাথায় গুলি: গণতন্ত্রের মর্যাদা ও নাগরিক নিরাপত্তার পরীক্ষা

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৯ এএম

ওসমান হাদির মাথায় গুলি: গণতন্ত্রের মর্যাদা ও নাগরিক নিরাপত্তার পরীক্ষা

ওসমান হাদির মাথায় গুলি: গণতন্ত্রের মর্যাদা ও নাগরিক নিরাপত্তার পরীক্ষা

১২ ডিসেম্বর ২০২৫ দুপুর আনুমানিক ২টা ২৫ মিনিটে ঢাকা শহরের পল্টন ও বিজয়নগর এলাকার বক্স কালভার্ট রোডে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর পরিকল্পিতভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়। তিনি ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী। ব্যাটারি চালিত রিকশায় চলাচলের সময় মোটরসাইকেলে থাকা দুই থেকে তিনজন সশস্ত্র হামলাকারী তাকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছোড়ে। একটি গুলি তার মাথায় প্রবেশ করে বেরিয়ে যায়। এতে মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাত লাগে।

চিকিৎসা ও বর্তমান অবস্থা

আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে গুলিটি বাম কানের ওপর দিয়ে মাথায় প্রবেশ করে ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ফলে মস্তিষ্কের উভয় পাশে গুরুতর ক্ষতি হয়েছে। জরুরি ব্রেইন সার্জারি সম্পন্ন করা হয়েছে এবং বর্তমানে তাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন।

তদন্ত ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

ঘটনার সময় আশপাশে সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার পর পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত ইউনিট এলাকাটি ঘিরে ফেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে এবং হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে লক্ষ্যভিত্তিক ও পরিকল্পিত হামলা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

জাতীয় প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

এই হামলার ঘটনা দ্রুতই জাতীয় উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আক্রমণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সাধারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়েছে। নির্বাচনের একদিন পর এমন হামলা হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। জনগণের মধ্যে ভয়, অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা আরও বেড়েছে।

মূল প্রশ্ন ও গণতান্ত্রিক দায়

প্রশ্নটি এখন অত্যন্ত স্পষ্ট। গণতন্ত্র কি সকলের জন্য সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে। নির্বাচনের সময় সাধারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা থেকেই এমন লক্ষ্যভিত্তিক হামলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে। এই ঘটনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও নৈতিকতা

গণতন্ত্রের আওতায় প্রত্যেক নাগরিক, প্রতিটি প্রার্থী ও সমর্থকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। আইন কিংবা রাজনীতির ঊর্ধ্বে মানুষের জীবন। নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। শরীফ ওসমান হাদি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হামলার শিকার হয়েছেন। এটি কেবল একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়। এটি জনজীবনের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর সতর্ক সংকেত। সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পর্যায়েই জনগণের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সামান্য ত্রুটিও জনআস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

সরকারের প্রতি প্রশ্ন ও প্রত্যাশা

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের কাছে আজ জাতির প্রশ্ন একটাই। আপনি কি সত্যিই একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে এসেছেন, নাকি পুরনো বৈষম্যের ওপর কেবল নতুন মুখ বসাতে। গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ যদি হয় সকল নাগরিকের জন্য সমান নিরাপত্তা, সমান সুযোগ এবং সমান রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, তাহলে রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নিরাপত্তা বণ্টন গণতন্ত্র নয়। এটি ক্ষমতার পক্ষপাত। যদি শরীফ ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা বারবার ঘটে, যদি হুমকির কথা জানানোর পরও রাষ্ট্র নীরব থাকে, আর একই সময়ে নির্দিষ্ট একজন নেতার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে জনগণ যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলবে এই সরকার আর আগের সরকারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোথায়।

শেষ কথা

ইতিহাস আপনাকে বিচার করবে আপনি কী বলেছিলেন তা দিয়ে নয়, বরং আপনি কার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন আর কাকে অনিশ্চয়তার মুখে ছেড়ে দিয়েছিলেন তা দিয়ে। রাষ্ট্র যদি নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে। আজও সময় আছে। পক্ষপাত নয় ন্যায়। ভীতি নয় আস্থা। বিশেষ নিরাপত্তা নয় সমান নিরাপত্তা। এই পথেই কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একটি নিরাপদ বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।

আরও একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা জরুরি। বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যদি সত্যিই আপনার প্রশাসন উপহার দিতে চায়, তবে শুধু কথা বললেই হবে না। Walk as you talk। আপনি যেমন বলেন, ঠিক তেমন করেই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিন এবং প্রমাণ করে দেখান। অন্যথায়, শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব আপনাকে ক্ষমা করবে না। এটি কোনো হুমকি বা হুঁশিয়ারি নয়। এটি গণতন্ত্রের পক্ষে সত্য ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর হৃদয়ের কথা।

এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কাউকে আঘাত করা নয়। উদ্দেশ্য একটাই। ভুল পথে গেলে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি করা, যাতে রাষ্ট্র সঠিক পথে চলতে পারে, নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং সবার স্বার্থেই গণতন্ত্র টিকে থাকে।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক,সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে অংশীজন অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন তামাক শিল্প

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে অংশীজন অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন তামাক শিল্প

বিশ্বের প্রথম উড-ডিজাইন মাদারবোর্ড আনলো গিগাবাইট

কাঠের নকশায় প্রযুক্তি বিশ্বের প্রথম উড-ডিজাইন মাদারবোর্ড আনলো গিগাবাইট

বিজয় দিবসের মেলায় আদিবাসী খাদ্য নিয়ে ‘আদিহাট’

বিজয় দিবসের মেলায় আদিবাসী খাদ্য নিয়ে ‘আদিহাট’

অর্থ পাচারের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেল সাইমন ওভারসিজ

অর্থ পাচারের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেল সাইমন ওভারসিজ

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App