×

প্রথম পাতা

নারীর মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত

Icon

ঝর্ণা মনি

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

 নারীর মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত

ছবি: সংগৃহীত

   

গত এক শতকের পুরোটাই বিশ্ব দেখেছে নারীর উন্নয়নের ঝলকানি। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দেশে দেশে রাজপথ কাঁপিয়েছেন নারীরা; ঝরিয়েছেন রক্ত। রক্তের দামে কিনেছেন অধিকার। তবুও এখনো গেল না আঁধার। মুক্তি মেলেনি বঞ্চনা থেকে, বৈষম্য থেকে। আর বঞ্চিত নারীরা সবচেয়ে বঞ্চনার শিকার মানসিক স্বাস্থ্যে। যেখানে এখনো নারীর স্বাস্থ্য নিয়েই দেশে খুব একটা আলোচনা হয় না; সেখানে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য অনেকের অগোচরেই থাকার মতো একটা বিষয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বজুড়েই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর প্রধান কারণ হিসেবে বিষণ্নতাকে চিহ্নিত করা হয়। ৫ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ জীবদ্দশায় বিষণ্নতার মধ্য দিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা আরও নাজুক। পুরুষের তুলনায় নারীরা এই রোগে চারগুণ বেশি ভোগেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন এবং নারীদের আক্রান্তের হার সেখানে ২১ শতাংশ। এক্ষেত্রে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীদের বিষণ্নতার অন্যতম কারণ হিসাবে পারিবারিক কলহ, যৌতুক প্রথা, শৈশবকালীন মানসিক আঘাত, সামাজিক এবং পারিবারিক বৈষম্য। অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনের পারিবারিক এবং সাধারণ পরিবেশের সঙ্গে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে না পারা বা অনেক সময় নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব থেকেও উদ্বিগ্নতায় ভোগেন তারা। এছাড়া যথাযথ সামাজিক দক্ষতা এবং আত্মনির্ভরশীলতার অভাবে অনেক নারীই মানসিক চাপকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে অবচেতন মনেই মানসিক চাপের শারীরিক প্রকাশ ঘটে যা ‘কনভার্শন ডিসঅর্ডার’ হিসেবে পরিচিত।

পরিসংখ্যান বলছে, ৭৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় ২৪ বছর বয়সের আগেই। ১৯ শতাংশ নারী অর্থাৎ প্রতি পাঁচ জনে প্রায় একজন অস্থিরতা নয়ত অবসাদে ভুগছেন। নারীর তুলনায় পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কিছু কম বলে জানাচ্ছে এজেন্ডা অ্যালায়েন্স ডটকম। মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এরকম পুরুষের হার ১২ শতাংশ। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সিদের মধ্যে যারা একবার হলেও নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন, এই সংখ্যা ৭৩ শতাংশ। বিশেষ করে টিন এজ মেয়েদের মধ্যে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে।

নারীকে তার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে প্রথমেই মানসিক স্বাস্থ্য কী, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাহত হলে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, একজন নারীর মানসিক চাপ সামলানোর দক্ষতা কেমন এবং কোথা থেকে সঠিক সমাধান পেতে পারেন, এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকলে একজন নারী তার মানসিক চাপ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক ভোরের কাগজকে বলেন, আগে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে অনীহা, স্টিগমা ছিল, তা থেকে কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। তবে একেবারে নেই, বলা যাবে না। কিন্তু মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তার কর্মক্ষমতা কমে যায়, সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়ে। ফলে তিনি যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নিতে আসবেন, তার চিকিৎসা সহজ হবে।

ট্রমা থেকে বের হতে পারেন না ৭৮ শতাংশের বেশি : ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের গবেষণার তথ্যমতে, সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হলে নারীদের মনোজগতে বিরাট প্রভাব পড়ে। মানসিক সমস্যায় ভোগা ৫৩ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিশুকালে ও পরিণত বয়সে শারীরিক যৌন সহিংতার শিকার হওয়া নারীর এক তৃতীয়াংশ, অর্থ্যাৎ ৭৮ শতাংশের বেশি আজীবন প্রাণঘাতি ট্রমা থেকে বের হতে পারেন না। এদের মধ্যে ১৬ শতাংশ পিটিএসডি বা পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারে ভুগে থাকেন। শিশু বয়সে ও বড় হয়ে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ, বা প্রতি তিনজনের একজন নারী আত্মহননের পথ বেছে নেন। আর প্রতি পাঁচজনে একজন বা ২২ শতাংশ নিজের কোনো না কোনো ক্ষতি করে বসেন। দরিদ্র নারীর মধ্যে ২৯ শতাংশের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। বিপরীতে এই ধরনের সমস্যা বিত্তশালী নারীর মধ্যে কম; ১৬ শতাংশের ক্ষেত্রে এমন দেখা যায়। ২৯ শতাংশ কালো, ২৪ শতাংশ এশীয় এবং ২৯ শতাংশ মিশ্র-বর্ণের নারীর বেলায় সাধারণত এমন ডিজঅর্ডার দেখা যায়। সাদা ও ব্রিটিশ নারী সেই তুলনায় এমন মানসিক সমস্যায় কম ভোগেন; পরিসংখ্যান বলছে, তাদের ক্ষেত্রে এই হার ১৬ শতাংশ।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার : নির্যাতিত নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের উদ্যোগে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে ২০০৯ সালে ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সেন্টারে সহিংসতার শিকার নারীরা মনো-সামাজিক কাউন্সেলিং সেবার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। ঢাকাসহ নয়টি বিভাগীয় জেলায় রিজিওন্যাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার রয়েছে। এগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রংপুর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী। ঢাকায় তিনজন ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজিস্ট এবং ঢাকার বাইরে রিজোওন্যাল সেন্টারগুলোতেও ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজিস্টের মাধ্যমে সেবা দেয়া হয়। দুইভাবে এ সেন্টার কাজ করে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তারা কাউন্সেলিং করে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এখানে সরাসরি, টেলিফোন এবং অনলাইনে কাউন্সেলিং করা হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণগুলো তারা বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে দেয়। এগুলো মনোসামাজিক কাউন্সিলিং দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নামে অন্তর্ভুক্ত। প্রশিক্ষণগুলো হলো- কাউন্সেলিং সেবার ওপর সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ, কাউন্সেলিংয়ের মৌলিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ, সাপোর্টিভ কাউন্সেলিং দক্ষতার প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ।

প্রশিক্ষণগুলোতে সাধারণত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। যেমন- ধর্মীয় নেতা, ইমাম, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী। তরুণদেরও এখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অনেক সময় সেন্টার সরকারি-বেসরকারি এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গেও কাজ করে। যেমন ব্র্যাক, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ কিংবা অন্যান্য এনজিও অংশগ্রহণকারী সংগ্রহ করে এবং সেন্টার তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

মনের যতœ নিন : বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু কর্মজীবী নারীরা তাদের দিনের একটা বড় সময় কর্মক্ষেত্রে থাকেন, সেখানে যে কোনো ধরনের মানসিক চাপ তার উৎপাদন ক্ষমতাকে ব্যাহত করতে পারে। তাই সম্ভব হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সমস্যাটি আলোচনা করা, সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করা এবং পরিবার থেকে যেন সম্পূর্ণ সাপোর্ট পাওয়া যায়, সে ব্যাপারটিও লক্ষ রাখতে হবে। অন্যদিকে যারা ঘরের কাজে দিনের পর দিন কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন, যাদের কাজের বিনিময়ে ধন্যবাদ পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কম, তাদের জন্য সবার প্রথম হলো নিজের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়ান। পরিবারের সঙ্গে সমস্যা নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলুন। মানসিক চাপ সামলানোর জন্য কী ধরনের সহযোগিতা দরকার তার একটা স্পষ্ট ধারণা দিন সবাইকে। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহিমা সুলতানা ভোরের কাগজকে বলেন, পুরুষের তুলনায় দেড় গুণ বেশি নারী মানসিক সমস্যায় ভোগেন। প্রবীণদের মধ্যেও বাড়ছে এ রোগের প্রকোপ। প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের যতœ বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম অথবা কিছুক্ষণ হাঁটা, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App