আইনি পথেই নিষিদ্ধ হতে পারে আওয়ামী লীগ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৫ এএম

ছবি : সংগৃহীত
ভারত থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় ছয় মাস পর দলটি নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এবার দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেবে প্রসিকিউশন। প্রসিকিউটরদের মতে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, আইনে চার ধরনের শাস্তির মধ্যে একটি হচ্ছে দল নিষিদ্ধ করা। অপরাধ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগ দলীয় সিদ্ধান্তে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মাঠে নামাতে, যা তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
আরো পড়ুন : আওয়ামী লীগের বিচারে তদন্ত শুরু
মানবতাবিরোধী অপরাধে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনতে গত ১০ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। সংশোধিত আইনের ২০বি ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংগঠন যদি আইনটির ধারা ৩(২)-এর অধীনে অপরাধ সংঘটন, আদেশ, উসকানি, প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা সহায়তা করে, তবে ট্রাইব্যুনাল তার কার্যক্রম স্থগিত, নিবন্ধন বাতিল, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি দ্রুত তদন্ত শেষ করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই দলটির বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এর আগে, আন্দোলনের মুখে গত ১২ মে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মী ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেশজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
প্রজ্ঞাপনে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে দলটি গুম, খুন, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে, যা দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রমাণিত।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বিচারের মূল নীতি হলো যে সময়ে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে সময়ের আইনে যেটা অপরাধ ছিল না, পরবর্তীতে তা অপরাধ বানিয়ে শাস্তি দেওয়া যায় না। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদেও এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।’
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের প্রসঙ্গে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, যদি কোনো দল মানবতাবিরোধী অপরাধ করে থাকে, তাহলে তার বিচার হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ যে ভয়াবহ অপরাধ করেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। রাষ্ট্র যেভাবে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে, সেটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, এবং জাতি প্রত্যাশা করে এই অপরাধের বিচার হবে।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলও তাদের প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, আন্দোলন দমন ও চিকিৎসা বঞ্চনা ঘটেছে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, অনেক সাক্ষী তাঁদের জবানবন্দিতে আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার কথা বলেছেন। এসব বক্তব্য এখন জুডিশিয়াল ডকুমেন্ট। ভবিষ্যতে দলের বিরুদ্ধে তদন্তে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৪ দলীয় জোটের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্তে যদি দেখা যায় অন্য কোনো দলও জড়িত ছিল, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে, গত বছরের ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগ হত্যা, ধর্ষণ, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল, যার প্রমাণ গণমাধ্যমে ও আদালতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি শেষে বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণ হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এটি দলীয়ভাবে সংঘটিত অপরাধ। তাই আওয়ামী লীগকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা উচিত।