সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম–দুর্নীতি: কাগজে কাজ, বাস্তবে নেই
হারিছ আহমেদ, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৪ পিএম
ছবি : ভোরের কাগজ
কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় চলতি অর্থবছরের ইউনিয়ন উন্নয়ন সহায়তা, টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বহু স্থানে কাজ না করেই বিল উত্তোলন, পুরনো রাস্তা বা ড্রেন মেরামতের নামে অল্প কিছু কাজ দেখানো, এমনকি একই স্থানে দুটি প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি টাকা ও চাল আত্মসাতের ঘটনাও পাওয়া গেছে।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা জনপ্রতিনিধি, প্রকল্প কমিটি এবং উপজেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ তুলেছেন।
রাউতি ইউনিয়নে সাম্প্রতিক তিন অর্থবছরে একের পর এক প্রকল্প বরাদ্দ হলেও অধিকাংশের কোনো কাজ মাঠে দেখা যায়নি। ২০২২–২৩, ২০২৩–২৪ ও ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বানাইল বাজার গুরুস্থান রোড থেকে দুলাল মিয়ার দোকান পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও সিসি ঢালাইয়ের জন্য বরাদ্দ হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু স্থানীয়রা জানান, রাস্তা প্রায় ১০ বছর আগেই নির্মিত, নতুন কোনো কাজ হয়নি। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যও প্রকল্পের বিষয়ে কিছু জানেন না।
একই ওয়ার্ডের পাড়া বানাই এলাকায় খাইরুল ইসলামের বাড়ি থেকে সামনের পাকা রাস্তায় সিসি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ২ লাখ টাকা থাকলেও কাজের কোনো চিহ্ন নেই। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভাওয়াল আদলপুর ও মনির মিয়ার ফিশারির দুটি ইট সলিং প্রকল্পের প্রতিটির বরাদ্দ ৫ লাখ টাকা, তবু কোথাও একটি ইটও বসানো হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুররা এলাকায় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাইট ড্রেন প্রকল্প, শিমুলাটি কামরুলের বাড়ি থেকে মাদ্রাসা হয়ে বকুলের বাড়ি পর্যন্ত ৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকার সলিং প্রকল্প এবং বড়ীগাতি মসজিদের সামনে ৩ লাখ টাকার ড্রেন বর্ধিতকরণ প্রকল্প, সবই কাজহীন।
আরো পড়ুন : শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নেপথ্যে যে বাধা
রাউতি ইউপি চেয়ারম্যান নূর শরীফ উদ্দিন আলম জুয়েল বলেন, এসব কাজ মূলত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব। আগের সরকারের সময় কিছু ভুল–ত্রুটি ছিল, পুরোপুরি এড়ানো যায় না। এখন থেকে নতুন প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে করা হবে।
রাউতি ছাড়াও তাড়াইলের সব ইউনিয়ন, তাড়াইল–সাচাইল, জাওয়ার, ধলা, দামিহা, দিকদাইড়, তালজাঙ্গায় একই ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। কোথাও সামান্য কাজ দেখানো, কোথাও পুরনো রাস্তা দেখিয়ে নতুন প্রকল্প দেখানো—পুরো উপজেলাজুড়েই চলছে একই অবস্থা।
ঠাকুরপাড়া গ্রামে রেনু মিয়ার বাড়ি থেকে আতহার আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা আগে থেকেই সিসি ছিল এবং আংশিক পুরনো ইটের সলিং ছিল। সেখানে নতুন করে ২ লাখ টাকার প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দ নেওয়া হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, পুরনো ইট তুলে আবার সেই ইট বসিয়ে নতুন কাজ দেখানো হয়েছে।
ইউপি সদস্য ও প্রকল্প কমিটির সভাপতি মোছা. জাহানারা সরাসরি বলেন, বিল পাইছি দুই লাখ। চেয়ারম্যানকে ৩০ হাজার, পিআইও অফিসে ২০ হাজার, এলাকার ছেলেপুলারে মিষ্টি খাওয়াইতে ১০ হাজার দিছি। সচিবের ৫% এখনো দেই নাই। এখন বলেন, আমার কী থাকে?
ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিপ্লব ঘোষ স্বীকার করেন, হ্যাঁ, রাস্তা আগেই ছিল। কিছু কাজ করা হয়েছে, বাকিটা ইউনিয়নের উন্নয়নে খরচ হবে। এ নিয়ে স্থানীয়দের প্রশ্ন- কোনো প্রকল্পের টাকা ইউনিয়নের অন্য খাতে খরচ করার ক্ষমতা কার আছে?
পাইকপাড়া রাস্তা থেকে মেনু মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার প্রকল্পের পাশাপাশি একই স্থানে আবুল হাশেম নামে আরেকটি প্রকল্প দেখানো হয়েছে, যেখানে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৬ মেট্রিক টন চাল।
প্রকল্প কমিটির সভাপতি ফারুক মিয়া বলেন, “লিখার সময় ভুল হইছে। বিলের সময় মাস্টাররোল ঠিক করে নিছি।” এ ব্যাখ্যায় স্থানীয়দের ক্ষোভ আরো বেড়েছে।
দামিহা ইউনিয়নের মাখনাপাড়া–বোরগাঁও সড়কের ১৫ লাখ টাকার প্রকল্প শ্রমিক দিয়ে করার কথা থাকলেও ইউপি চেয়ারম্যান করেছেন ভেকু দিয়ে। মাটি তোলা হয়েছে আশপাশের ফসলি জমি থেকে। অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। মাখনাপাড়া–শ্মশানঘাট ১ লাখ টাকার প্রকল্পেও নেই কোনো কাজের চিহ্ন।
জাওয়ার ইউনিয়নের বেলংকা–টেংরাকান্দা সড়কের ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকার ইট সলিং প্রকল্পের অর্ধেকও হয়নি বলে অভিযোগ। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মেহেদী হাসান টিটু বলেন, ৪৩টি টিআর ও ৪৫টি কাবিখা প্রকল্পে দুই কোটি টাকার কাজ চলছে। ৭০ শতাংশ কাজ শেষ, যাচাইয়ের পর বিল দেওয়া হয়েছে।
তাড়াইলের ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো. জিসান আলী বলেন, আগের প্রকল্প সম্পর্কে কিছু জানি না। তবে এ অর্থবছরে কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিল দিয়েছে কি-না, তদন্ত হবে। প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা দুর্যোগ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. বদরুদ্দোজা বলেন, একই স্থানে একাধিক প্রকল্প দেখানো আত্মসাতের শামিল। কাজ না করে বিল তোলা সম্ভব নয়। অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
