×

অর্থনীতি

তেল নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড!

ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, সরকার বলে জানে না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৩৫ পিএম

ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, সরকার বলে জানে না

ছবি : সংগৃহীত

দেশের বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে তুলকালাম কারবার বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। গত মঙ্গলবার কোনো ঘোষণা ছাড়াই নীরবে ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এবার এক লাফে লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৯ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগাম ঘোষণা ছাড়া এভাবে কূটকৌশলে দাম বাড়ানো চরম অন্যায়।

সরকারের সংশ্লিষ্টদের উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা। কিন্তু এক দিন পর গতকাল বুধবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাফ জানিয়েছেন, সরকার এ ব্যাপারে কিছুই জানত না এবং কোম্পানিগুলোকে আইনগত ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা আরো বলেন, আমরা আধা ঘণ্টা আগে এটা জেনেছি। কোম্পানিগুলো সামগ্রিকভাবে একত্রিত হয়ে এ কাজটি (ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো) করেছে। তাদের করা এ কাজটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এদিকে, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, বাজার তদারকি বিষয়টা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যও কিন্তু বড় বিষয়। ভোক্তাদের স্বার্থে বাজার তদারকি জোরদার করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। 

রোজকার দ্রব্য হিসেবে রান্নায় সয়াবিন তেল লাগে। কিন্তু সেটি কিনতে গিয়েই এবার একেবারে নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। গত অক্টোবর মাসেও সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তখন বাণিজ্য উপদেষ্টা সাফ জানিয়ে দেন, এভাবে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। পরে দর বাড়ানো থেকে সরে আসেন ব্যবসায়ীরা।

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং সরকারের সংশ্লিষ্টরা। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, দাম বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয় বা ট্যারিফ কমিশনের অনুমতি লাগে না। এছাড়া বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। তাই সরকারকে অবহিত করেই দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ব্যবসায়ীরা আবেদন করেছেন। কিন্তু দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব বলেন, এটা তো তাদের বক্তব্য। তাদের ওই কথা আমরা স্বীকার করি না।

এদিকে রাজধানীর কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপচাঁদা, তীর, পুষ্টি, ফ্রেশসহ প্রায় সব ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে বাজারে আসা পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়। এছাড়া বোতলজাত প্রতি লিটার ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোতলজাত প্রতি লিটার এতদিন ১৮৯ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। তবে এক ও দুই লিটারের নতুন দরের বোতল এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হয়নি। মালিবাগ কাঁচাবাজারে ফ্রেশ ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনে বাসায় ফিরছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী সায়হাম কবির। কত দাম নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে নতুন বাড়তি দরের তেল আসছে। কয়েকটি দোকান ঘুরে পরিচিত দোকানদারের কাছ থেকে আগের দরে, অর্থাৎ ৯২০ টাকায় নিয়েছেন। বোতলের গায়ে দাম লেখা ছিল ৯২২ টাকা। ওই মার্কেটে কয়েকটি দোকানে নতুন ৯৬৫ টাকা দরের তেল দেখা গেছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, গত ১০ নভেম্বর ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছিল কোম্পানিগুলো, যা ২৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হবে বলে জানানো হয়। সমিতি প্রতি লিটার বোতলজাত তেলের দর ১৯৯ টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতল ৯৮৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭৯ ও পাম অয়েল ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত সরকার দাম বাড়ানোর অনুমতি দেয়নি ব্যবসায়ীদের। 

এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টাও সাংবাদিকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা যেভাবে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছেন, তার আইনগত ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, আধা ঘণ্টা আগে তিনি বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখন ব্যবস্থা নেবে। সরকারকে না জানিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য উপদেষ্টা আরো বলেন, গত মঙ্গলবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জন্য দেড় কোটি লিটার ভোজ্যতেল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ লিটার সয়াবিন তেল ও এক কোটি লিটার রাইস ব্রান তেল কেনা হবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, সরকার গতকাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে দামে ভোজ্যতেল কিনেছে, আজ বাজারে তার চেয়ে ২০ টাকা বেশি দামে তেল বিক্রি হচ্ছে। তিনি এর যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। বিষয়টি হলো, পূর্বঘোষণা ছাড়াই নীরবে ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এবার প্রতি লিটারে ৯ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা এত ক্ষমতাধর হয়ে গেল কীভাবে যে সরকারকে পাশ কাটিয়ে তারা তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, এ প্রশ্ন ব্যবসায়ীদের করুন। আমরা আলোচনা করেছি, পদক্ষেপ নিচ্ছি। এটা তো বাজারে গিয়ে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করার বিষয় নয়। শেখ বশিরউদ্দীন আরো বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ থাকলে আলোচনা করা যাবে। সরকার সরবরাহ ব্যবস্থা গতিশীল রাখতে চায়। সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করতে চাই না আমরা। বাজারের ওপর থেকে সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণ আছে কি নেই সেটা আমাদের পদক্ষেপের মাধ্যমে জানতে পারবেন। আমরা আমাদের পদক্ষেপগুলো তো নেব। আমরা তো আলোচনায় বসছি। এটা তো আর মানে...মার্কেটে যেয়ে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করার জিনিস না! আমাদের পদক্ষেপগুলো নেয়ার জন্য আমাদের আলোচনার প্রয়োজন আছে। 

আইনসঙ্গত সব ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও এ সময় আশ্বাস দেন তিনি। অতীতে ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা খুব একটা দেখা যায়নি- দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, তারা বিজ্ঞপ্তি আকারেও দাম বাড়িয়েছিল, যেটাতে আমরা রাজি হই নাই। গত আড়াই মাস তো প্রায় পূর্বের ওই দামেই বেচাকেনা হয়েছে। যদি যৌক্তিক কোনো কারণ থাকে (দাম) বাড়ানোর, আমরা আলোচনা করতে চাই। কারণ আমরা তো সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে চাই না।

এদিকে গতকাল বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের খসড়া নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকের পর কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি সাবেক সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, এ আইন অনুযায়ী কিছু পণ্যের মূল্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দেয়। মূল্য নির্ধারণ কীভাবে করা হবে, সেটার একটা সূত্র আছে। হঠাৎ করে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৯ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার সমিতি যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে তেলের দাম বাড়ায়, আমি বলব, তা আইনের ব্যত্যয়। ক্যাব সভাপতি আরো বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া তেলের দাম বৃদ্ধি ভোক্তার অধিকারের প্রশ্ন। বাণিজ্য উপদেষ্টা যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন, আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি।

পরিশোধন কারখানা বন্ধ করে দেয়ার মতো বিধানও আইনে আছে জানিয়ে ক্যাব সভাপতি বলেন, প্রতিযোগিতা আইন আছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। যদি কেউ মজুত করে দাম বাড়ায়, সেখানে বিশেষ আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাও আছে। আমরা সেই আইনের প্রয়োগ দেখতে চাই। ক্যাবের সভাপতি আরো বলেন, ইদানীং তদারকি বিষয়টা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যও কিন্তু বড় বিষয়। ভোক্তাদের স্বার্থে বাজার তদারকি জোরদার করা উচিত। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশে যা বলা আছে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল অব অ্যাসেনসিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট-১৯৫৬ অনুসারে, ২০১১ সালে একটি আদেশ জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যা অত্যাবশ্যাকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ হিসেবে পরিচিত। এ আদেশে বলা আছে- উৎপাদক, পরিশোধক বা আমদানিকারক অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিকভাবে হ্রাস, বৃদ্ধি বা পুনর্নির্ধারণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে করবেন। তবে ১৫ দিন আগে তা মনিটরিং সেল, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ আদেশ অনুসারে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। 

তবে সরকারের অনুমতি ছাড়া এভাবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেয়া ‘অবশ্যই অন্যায়’ বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, বিষয়টি জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খতিয়ে দেখতে পারে। সেই সঙ্গে অনুমতি ছাড়া কেন দাম বাড়ানো হয়েছে, সে ব্যাপারে কোম্পানিগুলোকে জিজ্ঞেস করতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সফিকুজ্জামান বলেন, প্রতি বছর রমজানের আগে দাম বাড়ানোর চেষ্টা থাকে ব্যবসায়ীদের। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

প্রহসনের নির্বাচন থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে

পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা প্রহসনের নির্বাচন থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে

খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি

খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি

পাবনায় কোর্ট চত্বরে নারী আইনজীবীকে হত্যার হুমকি, থানায় জিডি

পাবনায় কোর্ট চত্বরে নারী আইনজীবীকে হত্যার হুমকি, থানায় জিডি

সরকারের শেষ সময়ে দাবির হিড়িক

সরকারের শেষ সময়ে দাবির হিড়িক

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App