মাতৃমৃত্যুর চিত্র এখনো আশাব্যঞ্জক নয়
৫৫ শতাংশই হয় প্রসব পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায়
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
কয়েক দশকে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। প্রতি লাখে জীবত জন্মে ১৩৬ জন মা মারা যান। এই মৃত্যুর ৫৫ শতাংশ মৃত্যু হয় প্রসব পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। অথচ সামান্য কিছু উদ্যোগ আর সচেতনা এসব মৃত্যু রোধ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে মৃত্যুগুলো হয় তার অধিকাংশই হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর খিঁচুনি বা একলামশিয়ায়। পরিস্থিতি যখন জটিল হয়ে যায় তখন এই রোগীদের রেফার করে পাঠানো হয় অন্য হাসপাতালে। যাতায়াতের এই সময়টা রোগীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবের পর রক্তক্ষরণ বন্ধে যাদুকরী একটি ওষুধ মিসোপ্রোস্টল। রোগীর জ্বিভের নিচে এই ওষুধ দিয়ে দিলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। ঠিক তেমনি খিঁচুনি রোধে স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি ৫ গ্রাম করে দু’টি ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ইনজেকশন রোগীর দুই থাইতে দিয়ে রেফার করে তাহলে খিঁচুনিটা কমে যায়। এই তথ্যগুলো জানা থাকলে এবং মেনে চললে অনেক মায়ের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সদস্যদের সঙ্গে স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসকদের প্রতিষ্ঠান অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলিজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)এর এক মতবিনিময় সভায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এসব কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বিএমএ ভবনের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এই সভায় ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্যের বর্তমান পরিস্থিতি ও মাতৃসেবার মান উন্নয়নের একটি প্রকল্প যেখানে স্বল্প মূল্যে সহজে তৈরি করা যায়, এমন একটি উদ্ভাবন প্রদর্শন করেন, যা লাখ লাখ মায়ের জীবন বাঁচাতে পারে। সংগঠনের আরেক সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্যের বর্তমান পরিস্থিতি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ক তথ্য তুলে ধরেন। বক্তব্য রাখেন ওজিএসবি’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম ও অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী, সংগঠনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. সাহেলা বেগম চৌধুরী, বাংলাদেশ হেলথ রিপোটার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ রাব্বি।
এদিকে অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম তার উপস্থাপনায় বলেন, সন্তান প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি মায়ের ৫’শ মিলিলিটার বা এর বেশি রক্তক্ষরণ হয়, প্রাথমিকভাবে একে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ বলে ধরা হয়। এখন কথা হচ্ছে এর পরিমাপ কীভাবে হবে? সেই ভাবনা থেকেই ‘ঢাকা ড্রেপ’-এর উদ্ভাবন। সেই উদ্ভাবনের বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি জানান, এটি স্বল্প মূল্যে সহজে তৈরি করা যায়। আর লাখ মায়ের জীবন বাঁচাতে পারে।
ডেমো হিসেবে তিনি দেখান, সহজলভ্য স্বচ্ছ/স্বল্পস্বচ্ছ বড় একটি পলিথিনের ব্যাগের মাধ্যমে কৌশলে ত্রিকোণ আকৃতির দাগাঙ্কিত থলি স্বাভাবিক প্রসবের সময়ে ব্যবহার করে প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব পরিমাপ করে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে মাতৃমৃত্যু সফলভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এটি নার্স ও মিডওয়াইফরা হাসপাতালে তৈরি করতে পারেন, যার মূল্য মাত্র ৫ টাকা; প্রকল্পে এটির সফল ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন ব্যাপক আকারে এর ব্যবহার হলে অনেক মা’ এর সুফল পাবেন।
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান জানান, দেশে যে সংখ্যক মাতৃমৃত্যু হয় তার ৫৪ শতাংশই হয় বাড়িতে। এছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পথে রাস্তায়ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মায়ের মৃত্যু হয়। দক্ষ প্রসবকারী দ্বারা প্রসবের হার ৪২ শতাংশ, দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর দ্বারা কমপক্ষে ৪টি প্রসব পূর্ব সেবা নেয়ার হার ৩১ শতাংশ, আর একবার সেবা নেয়া হার প্রায় ৬৪ শতাংশ। দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর দ্বারা প্রসবোত্তর সেবা নেয়ার হার ৩৪ শতাংশ।
দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশই বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে আর ১৮ শতাংশ সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রসব হয়। সেই হিসাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসবের হার সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাইতে ৪ গুণ বেশি। এদিকে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে প্রসবের হারও দিন দিন বাড়ছে। এর অধিকাংশই হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
অধ্যাপক ডা. রওশনা আরা বেগম বলেন, গ্রামে প্রসবের পর অনেক মা’ই ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকতে চান না। প্রসবের পর বাচ্চা নিয়ে দ্রুতই বাড়ি ফিরে যান। অনেক সময় বাড়িতে ফেরার পথে কিংবা বাড়িতে গিয়েও মায়ের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এই সময় যদি হাসপাতালে আনার সময় রোগীর জ্বিভের নিচে মিসোপ্রোস্টল দিয়ে দেয়া যায় তাহলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। এই তথ্যটুকু আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে খিঁচুনি। অথচ স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি ৫ গ্রাম করে দু’টি ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ইনজেকশন রোগীর দুই থাইতে দিয়ে রেফার করে তাহলে খিঁচুনিটা কমে যায়। এই তথ্যগুলো স্বাস্থ্যসেবা দানকারী নার্স বা মিডওয়াফদের জানা থাকলে অনেক মায়ের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। অধ্যাপক ডা. সাহেলা বেগম চৌধুরী বলেন, মাতৃমৃত্যুর আরেকটি কারণ হলো রক্তস্বল্পতা।
সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে প্রসবের হার বাড়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, অধিকাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে লেবার রুম নেই। নেই মিডওয়াইফ। ফলে সেখানে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার বেশি। এই বিষয়টি কয়েকবারই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জানানো হয়েছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই নিয়ম মানতে বাধ্য করার বিষয়ে সরকার যে উদ্যোগ নিবে ওজিএসবি সেই উদ্যোগের সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু এখনো সেই উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বক্তারা আরো বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.১ অনুযায়ী ২০৩০ নাগাদ বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যুর হার ৭০ এর কম অর্জন করতে হবে। যদিও বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার যথেষ্ট কমেছে, কিন্তু বর্তমানে এই হ্রাসের হার অনেকটাই স্থিমিত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সবার উদ্যোগ আরো গতিশীল, মানসম্মত ও ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে বলা হয়, নেতৃত্বের বিকাশ, দলগত সিদ্ধান্ত ও কার্যকর যোগাযোগের প্রশিক্ষণ; জরুরি প্রসূতি সেবা নিশ্চিতকরণ; প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ, উপকরণ ও মানব সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ; শক্তিশালী মনিটরিং এবং গণমাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইতিবাচক তথ্য ও বাস্তব চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন।
