×

সাহিত্য

হার মানিয়েছেন রবার্ট ব্রুসকে: ‘সুখবর বাংলাদেশ’-এর পাতায় সুলতানের গল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৪:২০ পিএম

হার মানিয়েছেন রবার্ট ব্রুসকে: ‘সুখবর বাংলাদেশ’-এর পাতায় সুলতানের গল্প

‘সুখবর বাংলাদেশ’-এর পাতায় সুলতানের গল্প

ব্যর্থতা যে সাফল্যেরই সোপান, তার এক মূর্ত প্রতীক চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তরের তরুণ মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ। যার জীবনের গল্প হার মানাতে পারে স্কটিশ রাজা রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায়ের উপাখ্যানকেও। বারবার হোঁচট খেয়েও যিনি থেমে যাননি, বরং প্রতিটি ব্যর্থতাকে সিঁড়ি বানিয়ে পৌঁছেছেন সাফল্যের শিখরে। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তথ্যপ্রযুক্তি লেখক ও সাংবাদিক রাহিতুল ইসলামের ‘সুখবর বাংলাদেশ’ বইয়ে উঠে এসেছে অদম্য এই ফ্রিল্যান্সারের জীবন সংগ্রামের কথা।

বারবার ব্যর্থতার অধ্যায়

২০০২ সাল, এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া দিয়ে সুলতানের ব্যর্থতার গল্পের শুরু। কৃষক বাবার অমনোযোগী ছেলেটির জন্য হয়তো এটাই ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। লজ্জায় দ্বিতীয়বার আর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভাবেননি। ভেবেছিলেন, সিনেমার নায়কদের মতো ঢাকা গিয়ে ভাগ্য বদলাবেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সিনেমার চেয়েও কঠিন। মায়ের অনুরোধে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েও যখন ফেল করলেন, তখন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে হলেন কৃষক। এক বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করে সেবারও প্রকৃতি তাকে নিরাশ করে।

তবে সুলতানের জীবনে বন্ধুর ভূমিকা ছিল সবসময়ই ইতিবাচক। এক বন্ধুর অনুরোধে ২০০৪ সালে তৃতীয়বারের চেষ্টায় এসএসসির গণ্ডি পার হন তিনি।

ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম ও নতুন বিপর্যয়

এসএসসির পর কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার আকবর আলী খান কারিগরি কলেজে ভর্তি হন সুলতান। দরিদ্র কৃষক বাবার পক্ষে ছেলের পড়ার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। তাই লজিং থেকে এবং একটি বিমা কোম্পানিতে খণ্ডকালীন কাজ করে নিজের পড়ার খরচ চালান তিনি। এইচএসসি পাস করার পর বাল্যবন্ধু সাব্বিরের পরামর্শে ঢাকা পলিটেকনিকে স্থাপত্য বিষয়ে ছয় মাসের একটি থ্রিডি রেন্ডারিংয়ের কোর্স করেন।

কিন্তু এই কোর্সও তার ভাগ্য বদলাতে পারেনি। চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে পকেট ও মনোবল দুটোই যখন প্রায় শূন্য, তখন বন্ধু সাব্বিরই এগিয়ে আসেন। একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশির সুযোগ করে দিলেও তিন সপ্তাহের বেশি টেকেননি সুলতান। এরপর অন্য প্রতিষ্ঠানেও মাসখানেকের বেশি টিকতে পারেননি। বাসে-হেঁটে যাতায়াত আর দুপুরে দুটো শিঙাড়া খেয়ে দিন কাটানো সুলতানের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।

অবশেষে সাব্বির নিজের অফিসে শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা করে দিলে মাসিক চার হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরি পান সুলতান। কিন্তু ঈদের আগে বেতন-বোনাস না পাওয়ায় অভিমানে সেই চাকরিও ছেড়ে দেন। চরম হতাশা থেকে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

নতুন সূচনা ও ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি

২০০৯ সালে বন্ধু সাব্বিরের হাত ধরেই সুলতানের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সাব্বিরের থ্রিডি ড্রয়িং স্টুডিওতে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০১০ সালে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করলেও অভাব তাঁর পিছু ছাড়েনি। অতিরিক্ত আয়ের জন্য মায়ের সহযোগিতায় ৩০ হাজার টাকা ধার করে একটি কম্পিউটার কেনেন। অফিসের পর রাতভর বাইরের কাজ করে সংসারের অভাব দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যান।

কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে এরপর। শুধুমাত্র অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় তাঁর প্রথম সন্তান জন্মের পরই মারা যায়। এই ঘটনা সুলতানকে জীবনের এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি করে। অর্থের গুরুত্ব বুঝে দিনরাত পরিশ্রম শুরু করেন তিনি। কিন্তু ২০১৫ সালে সাব্বিরের সেই অফিসটিও বন্ধ হয়ে গেলে আবারও অথৈ সাগরে পড়েন সুলতান।

ফ্রিল্যান্সিং: সাফল্যের রাজপথ

এতকিছুর পরেও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না সুলতান। ২০১৫ সালের মে মাসে অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘আপওয়ার্ক’-এ একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। মাত্র সাত দিনের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাজ পান। শুরু হয় থ্রিডি ও টুডি রেন্ডারিংয়ের কাজ। স্ত্রী নাজমুন নাহারকেও কাজ শিখিয়ে নিজের সহযোগী করে নেন।

স্বামী-স্ত্রীর যুগলবন্দী প্রচেষ্টা সফল হয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত দুজন মিলে কাজ করার পর ২০২২ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করেন নিজেদের প্রতিষ্ঠান ‘আর্কিওভিজ’। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে চারজন স্থায়ী কর্মী রয়েছেন, যারা স্থাপত্য ও প্রকৌশল নকশার ত্রিমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক রেন্ডারিংসহ থ্রিডি অ্যানিমেশনের কাজ করেন।

সফল সুলতানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

আপওয়ার্ক থেকে এক লাখ ডলার আয়ের মাইলফলক স্পর্শ করার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি কাজ করে সুলতান আয় করেছেন আরও কয়েক গুণ বেশি। একসময়ের কপর্দকশূন্য সুলতানের মাসিক আয় এখন চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। গ্রামে বাবা-মায়ের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন পাকা বাড়ি।

তবে অতীতের কষ্ট ভোলেননি তিনি। ঈদের আগে কর্মীদের বেতন-বোনাস না পাওয়ার যন্ত্রণা নিজে ভুগেছেন বলেই, এখন সবার আগে নিজের কর্মীদের বেতন-বোনাস নিশ্চিত করেন। তার লক্ষ্য, ভবিষ্যতে ব্যবসায়ের পরিধি আরও বাড়িয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

সুলতানের মতে, ‘প্রত্যেককে আগে খুঁজে বের করতে হবে, কোন বিষয়টি তিনি ভালো বোঝেন। তারপর ধৈর্য নিয়ে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে সেই বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। সততার সঙ্গে পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই।’

‘সুখবর বাংলাদেশ’ বইটির লেখক রাহিতুল ইসলাম বলেন, ‘এটি শুধু একটি বই নয়, এটি একটি সাহসী সময়ের দলিল—যেখানে প্রযুক্তি, প্রতিভা ও প্রত্যয়ের গল্প রয়েছে। আর সুলতান মাহমুদের এই অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্মের কাছে এক বড় অনুপ্রেরণা হবে।’

‘সুখবর বাংলাদেশ’–এর  প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। মুদ্রিত মূল্য ৩৫০ টাকা। বইটি পাওয়া যাচ্ছে প্রথমার আউটলেটগুলোসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের দোকানে। অনলাইনে বইটি প্রথমা ডটকম ও রকমারি ডটকমে পাওয়া যাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন: সিইসি

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন: সিইসি

যেভাবে বিদেশের মাটিতে বসে দল গোছাচ্ছে আওয়ামী লীগ

যেভাবে বিদেশের মাটিতে বসে দল গোছাচ্ছে আওয়ামী লীগ

হার মানিয়েছেন রবার্ট ব্রুসকে: ‘সুখবর বাংলাদেশ’-এর পাতায় সুলতানের গল্প

হার মানিয়েছেন রবার্ট ব্রুসকে: ‘সুখবর বাংলাদেশ’-এর পাতায় সুলতানের গল্প

সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডে আরো দু'জন গ্রেফতার

সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডে আরো দু'জন গ্রেফতার

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App